**আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ট্রাম্পের কূটনীতি: সাফল্য নাকিris্কের পথে?**
যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় ক্ষমতা গ্রহণের পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছেন। চীন, ইউক্রেন, রাশিয়া, ইরান, মধ্যপ্রাচ্য এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে তিনি একযোগে কাজ করছেন।
তবে প্রশ্ন উঠেছে, এই তৎপরতা কি আমেরিকার কৌশলগত অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে, নাকি মিত্রদের দূরে সরিয়ে শত্রুদের উৎসাহিত করবে?
ট্রাম্পের এই বহুমুখী কূটনৈতিক প্রচেষ্টা একদিকে যেমন তাৎপর্যপূর্ণ, তেমনই এতে রয়েছে ঝুঁকি। তিনি ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির ওপর জোর দিলেও, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামো পরিবর্তনে তাঁর আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।
তাঁর এই নীতি বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে পারে, ছোট দেশগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তার করতে পারে, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি এবং ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের চেষ্টা করতে পারে। তবে এমন পদক্ষেপে বিপর্যয়ও আসতে পারে।
এই সপ্তাহে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম বড় বিদেশ সফরের প্রাক্কালে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট সুইজারল্যান্ডে চীনা বাণিজ্য প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, যেখানে ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে বলে জানা গেছে।
ওমানে, মার্কিন কর্মকর্তারা ইরানের সঙ্গে দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করেছেন, যদিও সেই আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের উত্তেজনা কমাতে সেক্রেটারি অফ স্টেট মার্কো রুবিও এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভেন্স একটি যুদ্ধবিরতি গঠনে সহায়তা করেছেন।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের মধ্যস্থতায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলোচনার জন্য রাজি হয়েছেন, যদিও এতে মস্কোর অবস্থান আরও সুসংহত হতে পারে।
অন্যদিকে, হামাস সম্প্রতি গাজায় আটক শেষ জীবিত মার্কিন জিম্মিকে মুক্তি দিতে রাজি হয়েছে বলে ট্রাম্প জানিয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, আলোচনার আগে ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি এবং মানবিক সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও, ব্রিটেন এর সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন করেছেন তিনি। আগামী সোমবার তিনি সৌদি আরব, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরে যাচ্ছেন, যা ধনী দেশগুলোর প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহ এবং উপসাগরীয় অঞ্চলের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবের বিষয়টি তুলে ধরবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের এই কূটনৈতিক তৎপরতা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। তবে, অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই ধরনের উদ্যোগ কতটা সফল হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
বিশেষ করে চীন과의 বাণিজ্য যুদ্ধ এবং ইরানের সঙ্গে আগের পরমাণু চুক্তি ভেঙে দেওয়ার মতো বিষয়গুলো এখনো অমীমাংসিত।
ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্র নীতির কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রথমত, আলোচনার দায়িত্বে থাকা অনেক কর্মকর্তাই আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে তেমন অভিজ্ঞ নন। মধ্যপ্রাচ্য, ইউক্রেন ও ইরানের সঙ্গে কূটনীতিতে জড়িত ট্রাম্পের বন্ধু স্টিভ উইটকফ একজন রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী।
এছাড়া, চীনের সঙ্গে জটিল বাণিজ্য বিষয়ক আলোচনায় অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে স্কট বেসেন্টের।
দ্বিতীয়ত, ট্রাম্পের অপ্রত্যাশিত এবং অস্থির সিদ্ধান্ত যেকোনো সময় যেকোনো আলোচনাকে ভেস্তে দিতে পারে। চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধের সময় শুল্ক বৃদ্ধি করে তিনি পরিস্থিতি আরও কঠিন করে তুলেছিলেন।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ট্রাম্পের এই অপ্রত্যাশিত আচরণ দর কষাকষির ক্ষেত্রে একটি কৌশল হতে পারে। কিন্তু এর ফলে বিশ্ববাজারে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
তৃতীয়ত, ট্রাম্পের নীতি প্রায়ই অনুমানযোগ্যতার বাইরে থাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর আক্রমণাত্মক মন্তব্য কর্মকর্তাদের দর কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে।
তবে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গে তাঁর আলোচনা কিছুটা উত্তেজনা কমাতে সহায়তা করেছিল।
ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এর রাজনৈতিকীকরণ। প্রতিটি ছোট সাফল্যের পরই ট্রাম্প একে বিশাল অর্জন হিসেবে তুলে ধরেন। এছাড়া, কর্মকর্তাদের অতি-প্রশংসা তাঁর আত্ম-অহমিকা বাড়ায়।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্পের এমন কিছু মন্তব্য শোনা যায়, যা অনেকের কাছে হাস্যকর মনে হয়েছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি প্রায়ই যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক স্বার্থ এবং ব্যক্তিগত লাভের দিকে বেশি ঝুঁকে থাকে, যা ঐতিহ্যবাহী মার্কিন মূল্যবোধের পরিপন্থী।
ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার বিনিময়ে খনিজ সম্পদের রাজস্ব ভাগাভাগির চুক্তি করতে বাধ্য করা হয়েছিল। এছাড়াও, কাতার থেকে কয়েকশ মিলিয়ন ডলার মূল্যের একটি বিলাসবহুল উড়োজাহাজ উপহার হিসেবে গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন তিনি, যা সম্ভবত একটি গুরুতর নৈতিক লঙ্ঘন।
মার্কিন নীতি বিশেষজ্ঞদের মতে, পররাষ্ট্রনীতির মূল পরীক্ষা হলো, এটি আমেরিকানদের জন্য কতটা নিরাপদ এবং সমৃদ্ধি বয়ে আনে।
ট্রাম্পের মিত্রদের ওপর আক্রমণ এবং স্বৈরশাসকদের প্রতি সমর্থন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আস্থা কমিয়েছে, যা মিত্রদের মধ্যে নিরাপত্তা চুক্তি নিয়ে নতুন করে চিন্তা করতে বাধ্য করছে।
সবমিলিয়ে, ট্রাম্পের এই কূটনৈতিক তৎপরতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করতে পারে। তবে এর ফলস্বরূপ মিত্রদের মধ্যে অবিশ্বাস এবং শত্রুদের মধ্যে উৎসাহ বৃদ্ধি পাওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।
তথ্য সূত্র: আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম।