শিরোনাম: মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে নতুন পথ: বন্ধুত্বের দাওয়াই, সমাজের আশ্রয়
বর্তমান সময়ে মানুষের জীবনযাত্রা দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে, বাড়ছে ব্যস্ততা। একাকিত্ব যেন এক নীরব ঘাতক রূপে আমাদের গ্রাস করছে। উন্নত বিশ্বের পাশাপাশি, আমাদের দেশেও মানুষজন বাড়ছে সামাজিক বিচ্ছিন্নতার দিকে।
এই পরিস্থিতিতে, স্বাস্থ্যখাতে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে – সামাজিক প্রেসক্রিপশন (Social Prescribing)। এটি প্রচলিত ঔষধের বাইরে, বন্ধুত্বের হাত ধরে সুস্থ জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়ার এক অভিনব উপায়।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণা অনুযায়ী, সেখানকার মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি সময় একা কাটায়। এর কারণ হতে পারে আধুনিক জীবনের চাপ, সম্পর্কের অভাব অথবা একাকিত্বের গভীর ক্ষত। মানুষের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর এই একাকিত্বের মারাত্মক প্রভাব পরে।
এমন পরিস্থিতিতে, শুধু ঔষধের ওপর নির্ভর না করে, সামাজিক সম্পর্ক ও কমিউনিটির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
মূলত, সামাজিক প্রেসক্রিপশন হলো স্বাস্থ্যসেবার অংশ হিসেবে, রোগীদের জন্য স্থানীয় কমিউনিটি কার্যক্রমের সুপারিশ। এই প্রেসক্রিপশনগুলোর মধ্যে থাকতে পারে খেলাধুলা, প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটানো, শিল্পচর্চা, সেবামূলক কাজ, অথবা কোনো সামাজিক গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হওয়া।
উদ্বেগে (anxiety), হতাশায় (depression) অথবা দীর্ঘমেয়াদী ব্যথায় (chronic pain) আক্রান্ত রোগীদের জন্য, ঔষধের পাশাপাশি সামাজিক সংযোগ স্থাপন করা অনেক উপকারী হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর পরিবেশ, সম্পর্ক এবং সমাজের একটা বড় প্রভাব রয়েছে। সামাজিক প্রেসক্রিপশন সেই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়। উদাহরণস্বরূপ, ব্যায়ামের মাধ্যমে যেমন মানসিক স্বাস্থ্য ভালো হয়, তেমনি সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে একাকিত্ব দূর করা যেতে পারে।
“দ্য কানেকশন কিয়োর: দ্য প্রেসক্রিপটিভ পাওয়ার অফ মুভমেন্ট, নেচার, আর্ট, সার্ভিস, অ্যান্ড বিলংগিং” বইয়ের লেখক জুলিয়া হটজ-এর মতে, সামাজিক প্রেসক্রিপশন প্রচলিত চিকিৎসার পরিপূরক। এটি ঔষধ বা থেরাপির বিকল্প নয়, বরং অতিরিক্ত একটি উপায়, যা রোগীকে সুস্থ হতে সাহায্য করে।
তিনি আরও বলেন, সামাজিক সম্পর্কগুলো আমাদের সুস্থতার জন্য খাদ্য ও পানির মতোই জরুরি।
বাংলাদেশেও সামাজিক বন্ধনের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের সংস্কৃতিতে পরিবার, বন্ধু এবং প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, যেমন – ধর্মীয় উৎসব, খেলাধুলা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে আমরা সামাজিক সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করতে পারি।
এছাড়াও, স্থানীয় বিভিন্ন সেবামূলক কাজে যুক্ত হওয়া, যেমন – বিদ্যালয়ে সাহায্য করা, দরিদ্র ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো – আমাদের মানসিক শান্তির জন্য খুবই প্রয়োজনীয়।
সামাজিক প্রেসক্রিপশন ব্যক্তিগত চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করা হয়। সবার জন্য একই ধরনের কার্যক্রম উপযুক্ত নাও হতে পারে। কারো জন্য হয়তো প্রকৃতির কাছাকাছি যাওয়া ভালো, আবার কারো জন্য খেলাধুলা বা সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া বেশি ফলপ্রসূ হতে পারে।
গুরুত্বপূর্ণ হলো, নিজের রুচি ও আগ্রহ অনুযায়ী একটি উপযুক্ত কার্যক্রম খুঁজে নেওয়া।
সামাজিক প্রেসক্রিপশন একাকিত্ব কমাতে সাহায্য করে, যা আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যারা একাকী বোধ করেন, তারা বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে অংশ নিয়ে তাদের জীবনকে আরও অর্থপূর্ণ করে তুলতে পারেন।
এর ফলে, তারা সমাজের অংশ হয়ে নিজেদের আরও সুরক্ষিত ও সুখী অনুভব করতে পারেন।
সুতরাং, আসুন, আমরা সবাই বন্ধুত্বের হাত ধরি, সমাজের সঙ্গে মিশে যাই। ঔষধের পাশাপাশি, সামাজিক সংযোগের মাধ্যমে সুস্থ জীবন গড়ি।
তথ্য সূত্র: সিএনএন