যুদ্ধবিধ্বস্ত মারিউপোলে রাশিয়ার ‘স্বপ্নের ছবি’, কলমের আঁচড়ে ভোলানোর চেষ্টা। ইউক্রেনের বন্দর নগরী মারিউপোল। এক সময় ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এই শহরটি এখন ধ্বংসস্তূপ।
রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনে শহরের প্রায় ৯০ শতাংশ বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। যুদ্ধের বিভীষিকা কাটিয়ে শহরটিতে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে রাশিয়া। তবে এক্ষেত্রে তারা বেছে নিয়েছে ভিন্ন কৌশল।
সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দাদের, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহারকারীদের কাজে লাগিয়ে এক ভিন্ন চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন-এর এক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, মারিউপোলের স্থানীয় কিছু বাসিন্দা, এমনকি স্কুল শিক্ষার্থীদেরও রাশিয়ার মদতে নতুন গণমাধ্যম বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
তাদের ‘ব্লগার স্কুল’-এ মিডিয়া বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মূলত, রাশিয়ার হয়ে কাজ করার জন্য এসব ব্লগার তৈরি করা হচ্ছে, যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শহরের ‘উন্নয়ন’-এর ইতিবাচক চিত্র তুলে ধরবেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়ার শাসনকে সমর্থন যোগানোর জন্য এই ধরনের স্থানীয় কণ্ঠস্বরগুলোর প্রয়োজন।
যদিও এসব ব্লগারের অনুসারীর সংখ্যা খুব বেশি নয়, তবুও তাদের কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, রাশিয়ার মূল লক্ষ্য হলো, স্থানীয়দের মধ্যে নিজেদের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করা। সম্প্রতি, মারিউপোলের একটি ব্লগার স্কুলের শিক্ষক পাভেল কারবভস্কি টিকটকে একটি ভিডিও প্রকাশ করেছেন।
যেখানে তিনি নতুন অ্যাপার্টমেন্ট ভবন নির্মাণের বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তার কথায়, “মারিউপোল আমাদের রাশিয়ান শহর!” কারবভস্কির মতো আরও অনেক কনটেন্ট ক্রিয়েটর আছেন, যারা রাশিয়ার অবৈধভাবে দখল করা চারটি অঞ্চলের (দনেৎস্ক, লুহানস্ক, খেরসন এবং জাপোরিঝিয়া) শহরগুলোতে উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরছেন।
কারবভস্কি অবশ্য দাবি করেছেন, তিনি কোনো প্রচারকের ভূমিকায় নেই। তিনি শুধু রাশিয়ান-অধিকৃত এলাকার জীবনযাত্রা সম্পর্কে ‘সত্য’ তুলে ধরতে চান। তবে, অনুসন্ধানে জানা গেছে, কারবভস্কির মতো কনটেন্ট নির্মাতাদের স্থানীয় রুশ-সমর্থিত কর্মকর্তারা তাঁদের কাজ করতে উৎসাহিত করছেন।
এমনকি, সরকারি বৈঠকেও তাঁদের এই বিষয়ে উৎসাহ দেওয়া হয়। জানুয়ারিতে, কারবভস্কিসহ বেশ কয়েকজন কনটেন্ট ক্রিয়েটরকে রাশিয়ার মদতপুষ্ট ‘দনেৎস্ক পিপলস রিপাবলিক’-এর প্রধান দেনিস পুশিলিনের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
পুতশিলিন তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, তাঁরা যেন ডনবাস অঞ্চলের ‘পুনর্গঠন’-এর বিষয়টি মানুষের কাছে তুলে ধরেন। সিএনএন-এর বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মারিউপোলে রাশিয়ার ‘রুশীকরণ’ প্রকল্পের প্রচারকারী এক ডজনের বেশি ব্লগারের প্রোফাইল রয়েছে।
এদের মধ্যে কেউ কেউ প্রকাশ্যে রাশিয়ার প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে এবং ইউক্রেনকে এই অঞ্চলের ক্ষতির জন্য দায়ী করছে। আবার কেউ কেউ রাজনীতি থেকে দূরে থাকার ভান করছে। টিকটকে তাদের অনুসারীর সংখ্যা ৩,০০০ থেকে ৩৬,০০০ পর্যন্ত হলেও, তাদের পুনর্গঠন বিষয়ক কনটেন্টগুলো কয়েক লক্ষ ভিউয়ার্স সংগ্রহ করে।
কিন্তু তাদের ভিডিওগুলোতে শহরের ধ্বংসের কারণ সম্পর্কে কোনো তথ্য দেওয়া হয় না। রাশিয়ার আক্রমণের শিকার হওয়া মারিউপোল শহরের আবাসিক এলাকার ৯০ শতাংশই হয় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, নয়তো ধ্বংস হয়ে গেছে।
যুদ্ধের আগে এখানকার জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৪ লাখ ৩০ হাজার। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি জানিয়েছেন, রাশিয়ার হামলায় প্রায় ২০ হাজার বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। যদিও এই সংখ্যা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
ইউক্রেন সরকারের কৌশলগত যোগাযোগ ও তথ্য নিরাপত্তা কেন্দ্রের পরিচালক ইগর সোলোভেই সিএনএন-কে বলেছেন, রাশিয়া তাদের সেনাবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের তথ্য গোপন করতে চাইছে। এর মোকাবিলায় ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছে দখলদারদের অপরাধ সম্পর্কে আরও বেশি তথ্য দেওয়ার জন্য।
রাশিয়ার জন্য মারিউপোলের নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও বিষয়টি একাধিকবার উল্লেখ করেছেন। এমনকি, তিনি মারিউপোলে গিয়ে স্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে ‘পুনর্গঠন’ কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করেছেন।
উপগ্রহ চিত্র, স্থানীয় বাসিন্দাদের সাক্ষাৎকার এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভিডিও বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শহরে এখনো ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন রয়েছে। অনেক বাসিন্দা, যারা যুদ্ধকালে ঘর হারিয়েছেন, তাঁদের এখনো পুনর্বাসন করা হয়নি। নতুন করে নির্মিত ঘরগুলোর মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
সেখানকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, রুশ কর্তৃপক্ষ ইউক্রেনীয়দের কাছ থেকে বাড়িঘর কেড়ে নিয়ে অন্যদের দিচ্ছে। ২০২২ সালে ঘর হারানো এক বাসিন্দা সিএনএনকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রাশিয়া এখানে ‘পটেমকিনের ছবি’ তৈরি করেছে।
অর্থাৎ, লোক দেখানোর জন্য কিছু কাজ করা হচ্ছে, বাস্তবে এখানকার মানুষ ভালো নেই। মারিউপোলে রাশিয়া কীভাবে তাদের প্রভাব বিস্তার করছে, তা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন। সেখানে নতুন করে যারা বাড়ি বানাচ্ছে, তাদের সুযোগ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।
যদিও সেখানকার বাসিন্দাদের অনেকেই বলছেন, বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। মার্চ ২০২৩-এ, রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন মিডিয়া সংস্থা গ্যাজপ্রোম-মিডিয়ার মালিকানাধীন ইউটিউবের বিকল্প প্ল্যাটফর্ম ‘রুটুবে’ ঘোষণা করে যে তারা মারিউপোলসহ চারটি অধিকৃত অঞ্চলে স্টুডিও স্থাপন করবে।
যেখানে কনটেন্ট নির্মাতারা উন্নত সরঞ্জাম এবং প্রশিক্ষণ সুবিধা পাবেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাশিয়ার এই কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য হলো, মারিউপোলের মানুষের মন জয় করা। স্থানীয় প্রভাবশালীরাই এক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করছে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন