লন্ডনের টেমস নদীর তীরে প্রত্নতত্ত্বের সন্ধানে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে, বাড়ছে লাইসেন্সের জন্য অপেক্ষারতদের সংখ্যা। এক সময় যেখানে শখের বশে কিছু মানুষ এই নদীর তীরে ডুব দিতেন, সেখানে এখন লাইসেন্স পেতে ১০ হাজারের বেশি মানুষের অপেক্ষা।
বিষয়টি একদিকে যেমন পুরনো শৌখিনদের হতাশ করেছে, তেমনই নদীর তলদেশে লুকিয়ে থাকা ঐতিহাসিক নিদর্শনের ভবিষ্যৎ নিয়েও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
টেমস নদীর তীরে কাদায় প্রাচীন জিনিস খুঁজে বের করার এই বিশেষ শখটি ‘মাডলার্কিং’ নামে পরিচিত। এক সময়ের দরিদ্র লন্ডনের মানুষেরা জীবিকা নির্বাহের জন্য নদীর কাদায় পরিত্যক্ত জিনিস খুঁজে বিক্রি করতেন।
বর্তমানে এটি শখের পর্যায়ে চলে এসেছে। কোভিড-১৯ মহামারীর সময় এই শখটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে, যখন বহু মানুষ নিজেদের বাড়ির কাছাকাছি নদীটিতে ঐতিহাসিক নিদর্শন খুঁজে বের করার সুযোগ পান।
পোর্ট অব লন্ডন অথরিটি (পিএলএ) কয়েক বছর ধরে সীমিত সংখ্যক মাডলার্কিং লাইসেন্স দিয়ে আসছিল। কিন্তু আগ্রহীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় কর্তৃপক্ষ নতুন আবেদন গ্রহণ বন্ধ করে দেয় এবং একটি দীর্ঘ অপেক্ষমাণ তালিকা তৈরি করে।
বর্তমানে সেই তালিকায় ১০ হাজারের বেশি মানুষ রয়েছেন। পুরনো লাইসেন্সধারীদের অনেকেই এই তালিকায় নাম লেখাতে পারেননি। তাদের আশঙ্কা, নতুন করে লাইসেন্স পেতে হয়তো কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে।
এই সিদ্ধান্তের ফলে সবচেয়ে বেশি হতাশ হয়েছেন লুসি পিল নামের এক মাডলার্কিং উৎসাহী। ২০২০ সাল থেকে তিনি এই কাজে জড়িত এবং এরই মধ্যে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের ‘পোর্টেবল অ্যান্টিকুইটিজ স্কিম’-এর ডেটাবেসে অন্তর্ভুক্ত করার মতো ৫০টির বেশি প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিস খুঁজে বের করেছেন।
লুসি বলেন, “খবরটি শোনার পর মনে হয়েছিল, জীবনে বড় ধরণের একটা ক্ষতি হয়ে গেল। যেন শোকের ছায়া নেমে এসেছে।”
তবে শুধুমাত্র শৌখিনরাই নন, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অভিজ্ঞ মাডলার্কিংকারীরা টেমস নদীর প্রত্নতত্ত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারা প্রতি বছর প্রায় ৭০০টি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস খুঁজে পান, যা ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে।
লন্ডন মিউজিয়াম ডকল্যান্ডসে মাডলার্কিংকারীদের খুঁজে পাওয়া জিনিস নিয়ে একটি প্রদর্শনী চলছে, যেখানে ভাইকিং যুগের ছোরা এবং রোমান যুগের বোর্ড গেমের একটি অংশও রয়েছে।
মাডলার্কিংয়ের এই জনপ্রিয়তা লাভের পেছনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও একটি বড় ভূমিকা রেখেছে। ক্লিয়ার মাড এবং লরেন্স পেইজ নামের এক দম্পতি তাঁদের অনুসন্ধানের ছবি ও ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করতেন।
তাঁদের ‘@muddlarks’ নামের অ্যাকাউন্টটি দ্রুত জনপ্রিয় হয় এবং অনুসারীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। তাঁদের মতো আরো অনেকে এই কাজে উৎসাহিত হয়েছেন।
২০২২ সালে পিএলএ নতুন আবেদন গ্রহণ বন্ধ করে দেয়। এরপর তারা নদীর তীরের পরিবেশের উপর মাডলার্কিংয়ের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করে। গবেষণায় জানা যায়, একসঙ্গে ৪ হাজারের বেশি লাইসেন্সধারীর কার্যক্রম নদীর পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
বর্তমানে পিএলএ সীমিত সংখ্যক অভিজ্ঞ মাডলার্কিংকারীদের লাইসেন্স নবায়নের অনুমতি দিচ্ছে। লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারের রেকর্ড এবং লন্ডনের সাংস্কৃতিক জীবনে অবদানের মতো বিষয়গুলো বিবেচনা করা হচ্ছে।
পিএলএ-র একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তাঁরা চান না, ১৫ হাজার মানুষ একসাথে নদীর তীরে গিয়ে সমস্ত ঐতিহাসিক নিদর্শন তুলে আনুক।
তবে অভিজ্ঞ মাডলার্কিং লারা মাইকেলম মনে করেন, জাদুঘরে গিয়ে এইসব জিনিস দেখা আর নদীর তীরে খুঁজে বের করার মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। তাঁর মতে, “মাডলার্কিংয়ের আসল আনন্দ হলো খুঁজে বের করার অনুভূতি।”
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক