রাসায়নিক বিক্রিয়ার ৭টি বিস্ময়কর ঘটনা: যা বদলে দিয়েছে দুনিয়া!

রসায়ন বিজ্ঞান: ইতিহাসের মোড় ঘোরানো ৭টি রাসায়নিক বিক্রিয়া

আমাদের চারপাশের জগৎ প্রতিনিয়ত নানান রাসায়নিক বিক্রিয়ার সাক্ষী। এমনকি, আমাদের শরীরও এর ব্যতিক্রম নয়। কয়েক সহস্রাব্দ ধরে মানুষ এই বিক্রিয়াগুলোকে নিজেদের সুবিধার্থে কাজে লাগাতে শিখেছে।

সাবান আবিষ্কার থেকে শুরু করে ব্রোঞ্জ যুগের সরঞ্জাম তৈরি— রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলো মানবসভ্যতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। আসুন, ইতিহাসের ওপর গভীর প্রভাব ফেলা এমন ৭টি রাসায়নিক বিক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।

১. সাবান তৈরি (Saponification):

আজ থেকে প্রায় ৫ হাজার বছর আগে, অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ২৮০০ অব্দে মানুষ আবিষ্কার করে— পশুর চর্বি, কাঠের ছাই এবং জল মিশিয়ে সাবান তৈরি করা যায়। এই প্রক্রিয়াটিই হলো “স্যাপোনিফিকেশন” নামক রাসায়নিক বিক্রিয়া।

শুরুতে, সাবান ব্যবহার করা হতো কাপড় বা পশমের মতো জিনিস পরিষ্কার করার জন্য। কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষ উপলব্ধি করলো, এটি তাদের শরীর পরিষ্কার করারও কাজে আসে।

রোগ জীবাণু আবিষ্কারের পর সাবানের গুরুত্ব আরও বাড়ে, কারণ এটি রোগ প্রতিরোধের গুরুত্বপূর্ণ উপায় হিসেবে দেখা দেয়। আধুনিক যুগে সাবান তৈরিতে কিছু পরিবর্তন এলেও, এর মূল প্রক্রিয়া সেই আদিম রাসায়নিক বিক্রিয়ার মতোই রয়ে গেছে।

২. অ্যামোনিয়া সংশ্লেষণ:

১৯০৯ সালে বিজ্ঞানী ফ্রিজ হ্যাবার কৃষি শিল্পে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনেন। তিনি বাতাস থেকে নাইট্রোজেন সংগ্রহ করে অ্যামোনিয়া তৈরি করার একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।

এই অ্যামোনিয়া ছিল উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজনীয় সার তৈরির মূল উপাদান। পরে, কার্ল বস এই প্রক্রিয়াকে আরও বৃহৎ পরিসরে নিয়ে যান, যা নাইট্রোজেন সার তৈরি করতে সহায়তা করে।

গাছপালা বেড়ে ওঠার জন্য নাইট্রোজেন অপরিহার্য, যা তারা সাধারণত মাটি থেকে গ্রহণ করে। কিন্তু ফসল সংগ্রহের ফলে মাটির নাইট্রোজেনের পরিমাণ কমতে থাকে, ফলে উৎপাদনশীলতা কমে যায়।

হ্যাবার-বশের এই পদ্ধতির ফলে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় এবং আধুনিক কৃষিকাজের সূচনা হয়। তবে, এই আবিষ্কারের একটি খারাপ দিকও ছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির সৈন্যদের জন্য প্রচুর পরিমাণে গোলাবারুদ তৈরি করতে হ্যাবারের এই প্রক্রিয়ার অ্যামোনিয়া ব্যবহৃত হয়েছিল। এছাড়াও, হ্যাবার ক্লোরিন গ্যাসও আবিষ্কার করেন।

৩. মেইলার্ড বিক্রিয়া:

এই বিক্রিয়াটির নাম হয়তো অনেকেই শোনেননি, কিন্তু এটি আমাদের রান্নাঘরের একটি খুবই পরিচিত ঘটনা।

রুটি সেঁকার সময় সোনালী-বাদামী হওয়া বা মাংস ভাজার সময় সুস্বাদু ক্রাস্ট তৈরি হওয়া— সবই এই মেইলার্ড বিক্রিয়ার ফল। রান্নার সময় খাবারে থাকা চিনি এবং প্রোটিন, তাপের প্রভাবে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে হাজারো নতুন যৌগ তৈরি করে, যা খাবারের স্বাদ এবং গন্ধ বৃদ্ধি করে।

প্রাচীন মানুষ যখন রান্না করা খাবার খাওয়া শুরু করে, তখন তারা বুঝতে পারে— রান্না করা খাবার সহজে হজম হয়, স্বাদ বেশি হয় এবং পেট অনেকক্ষণ ভরা থাকে।

৪. পেনিসিলিনের আবিষ্কার:

১৯২৮ সালে, আলেকজান্ডার ফ্লেমিং নামক এক বিজ্ঞানী ছুটি থেকে ফিরে এসে তার ল্যাবে এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা দেখতে পান।

তিনি খেয়াল করেন, স্ট্যাফিলোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া জন্মানোর জন্য রাখা একটি পাত্রে এক ধরনের ছত্রাক জন্মেছে এবং তার চারপাশে ব্যাকটেরিয়াগুলো বাড়তে পারছে না।

ফ্লেমিং এই বিষয়ে আরও গবেষণা করেন এবং বুঝতে পারেন, ছত্রাকটি এমন একটি পদার্থ তৈরি করছে যা ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলছে। এই ছত্রাকটি ছিল পেনিসিলিয়াম নোটাম, যা থেকে পেনিসিলিন তৈরি করা হয়।

ফ্লেমিংয়ের অক্লান্ত পরিশ্রমে তৈরি হওয়া এই অ্যান্টিবায়োটিক পরবর্তীতে হাওয়ার্ড ফ্লোরি এবং আর্নস্ট চেইন সহ আরও কয়েকজন বিজ্ঞানীর প্রচেষ্টায় আরও উন্নত হয়। পেনিসিলিন আবিষ্কার চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে এবং অসংখ্য মানুষের জীবন বাঁচায়।

৫. ক্লোরোফ্লুরোকার্বন (সিএফসি) তৈরি:

১৯২০-এর দশকে থমাস মিজলি জুনিয়র আবিষ্কার করেন ক্লোরোফ্লুরোকার্বন বা সিএফসি।

সে সময়ে রেফ্রিজারেটরে অ্যামোনিয়া, মিথাইল ক্লোরাইড ও সালফার ডাই অক্সাইডের মতো বিষাক্ত রেফ্রিজারেন্ট ব্যবহার করা হতো। সিএফসি ছিল নিরীহ, সহজে জ্বলে না এবং স্থিতিশীল— তাই একে আদর্শ বিকল্প হিসেবে মনে করা হয়েছিল।

কিন্তু কেউ জানত না যে, অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে সিএফসি ভেঙে যায়। ১৯৫০-এর দশকে সিএফসি রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার এবং অ্যারোসল-এর মতো বিভিন্ন পণ্যে ব্যবহৃত হতে শুরু করে।

পরবর্তীতে এটি বায়ুমণ্ডলে পৌঁছে যায় এবং সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির সঙ্গে বিক্রিয়া করে ওজোন স্তরকে ক্ষয় করতে শুরু করে।

১৯৭৪ সালে বিজ্ঞানীরা এই ক্ষতির পূর্বাভাস দেন এবং ১৯৮৭ সালে মন্ট্রিল প্রোটোকলের মাধ্যমে সিএফসি উৎপাদন প্রায় সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

বর্তমানে পৃথিবীর ওজোন স্তর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে।

৬. গাঁজন (Fermentation):

গাঁজন একটি প্রাকৃতিক রাসায়নিক প্রক্রিয়া, যেখানে অণুজীব, জটিল শর্করাকে ভেঙে অ্যালকোহল, অ্যাসিড এবং গ্যাসে পরিণত করে।

এই প্রক্রিয়াটি মানুষের অনেক আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল এবং সম্ভবত এটি একটি “দুর্ঘটনা” ছিল। ধারণা করা হয়, ১০,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মানুষ যখন খাবার সংরক্ষণের চেষ্টা করত, তখন এর সূচনা হয়।

মানুষ ধীরে ধীরে এই প্রক্রিয়াটির কৌশল রপ্ত করে এবং এর মাধ্যমে পনির, রুটি, দই, আচার, কিমচি ও অ্যালকোহলের মতো বিভিন্ন খাদ্য তৈরি করতে শুরু করে।

৭. সিলিকন বিশুদ্ধকরণ:

সিলিকন আমাদের চারপাশে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, তবে এটি সাধারণত অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে মিশে থাকে।

যেমন— বালি মূলত সিলিকন ডাই অক্সাইড, যা সিলিকন এবং অক্সিজেনের মিশ্রণ। ১৮৫৪ সালে ফরাসি রসায়নবিদ হেনরি এতিয়েন সেইন্ট-ক্লেয়ার ডেভিল সর্বপ্রথম বিশুদ্ধ সিলিকন তৈরি করেন।

সেই সময় এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না, তবে বর্তমানে এটি আধুনিক বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সিলিকনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো— এটি অর্ধপরিবাহী, অর্থাৎ এটি একইসঙ্গে বিদ্যুৎ পরিবহন করতে পারে এবং তাপ প্রতিরোধী।

এই কারণে এটি ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাইক্রোচিপ ও মাইক্রোপ্রসেসর তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। সিলিকন সহজলভ্য হওয়ায় প্রযুক্তি সবার জন্য সহজলভ্য হয়েছে।

সারসংক্ষেপ করলে, সার, মাইক্রোচিপ— এমন অনেক উদ্ভাবন রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফল। কিছু আবিষ্কার হয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে, কিছু হয়েছে অপ্রত্যাশিতভাবে।

আবার, সিএফসি-এর মতো কিছু আবিষ্কারের খারাপ প্রভাবও ছিল। ভালো বা খারাপ যা-ই হোক না কেন, মানুষ নতুন কিছু আবিষ্কার করা থেকে বিরত থাকবে না।

কারণ, মানুষের মন সবসময় অজানা জগৎকে আবিষ্কার করতে চায়।

তথ্যসূত্র: ট্রাভেল অ্যান্ড লেজার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *