মৃত্যুপথযাত্রী ভেনিস: পর্যটনের আগ্রাসনে কি শেষ রক্ষা?

শিরোনাম: “ভাসছে ভেনিস, ডুবছে ভবিষ্যৎ: পর্যটনের জোয়ারে অস্তিত্ব সংকটে ইতালির এই শহর”

ভূমধ্যসাগরের বুকে অবস্থিত, এক সময়ের পরাক্রমশালী ভেনিস শহর আজ এক গভীর সংকটের সম্মুখীন। একদিকে যেমন বাড়ছে সমুদ্রের জলতল, তেমনই পর্যটকদের অবিরাম আনাগোনা যেন শহরটির কফিনে শেষ পেরেকটি মারছে। ইতালির এই ঐতিহাসিক শহরে টিকে থাকার লড়াই এখন সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে।

জলবায়ু পরিবর্তন এবং লাগামছাড়া পর্যটনের ফলে এখানকার মানুষের জীবনযাত্রা চরমভাবে বিপর্যস্ত।

প্রতি বছর প্রায় তিন কোটি পর্যটকের আগমন ঘটে ভেনিসে। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের চাপে সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন অতিষ্ঠ। শহরের জনসংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে, বর্তমানে তা ৫০,০০০ এর নিচে নেমে এসেছে।

এর প্রধান কারণ হলো, পর্যটকদের জন্য ভাড়ার বাড়িতে (ভ্যাকেশন রেন্টাল) পরিণত হওয়ায় স্থানীয়দের জন্য বাসস্থানের অভাব দেখা দিয়েছে। দোকানপাট ও ব্যবসার অভাবে পর্যটন শিল্পের বাইরে অন্য কোনো পেশায় এখানকার মানুষের রুজি রোজগার করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

পর্যটকদের মধ্যে বেশিরভাগই আসেন দিনের বেলা, ফলে তারা শহরের সম্পদ ব্যবহার করলেও স্থানীয় অর্থনীতিতে তেমন কোনো অবদান রাখেন না। এই কারণে অনেকে ভেনিসকে “ডুবে যাওয়া শহর” বা “মৃতপ্রায় শহর” হিসেবে অভিহিত করেন।

ভেনিসের মেয়র অফিসের তথ্য অনুযায়ী, শহরের কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি সামাল দিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো দিনে আসা পর্যটকদের জন্য ৫ ইউরোর (প্রায় ৬০০ টাকা, ২৯শে অক্টোবর, ২০২৩ এর বিনিময় হার অনুযায়ী) প্রবেশ ফি চালু করা হয়েছে, যা ২০২৫ সালেও বহাল থাকবে। এছাড়াও, পর্যটকদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য একটি স্মার্ট কন্ট্রোল রুম তৈরি করা হয়েছে।

তবে, স্থানীয় অনেক বাসিন্দা পর্যটকদের নেতিবাচক প্রভাব কমাতে এবং শহরটিকে বাঁচিয়ে রাখতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তারা পর্যটকদের সঙ্গে কাজ করছেন, যাতে পর্যটকদের আগমন শহরের উপর বিরূপ প্রভাব না ফেলে।

এদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইমানুয়েল ডাল কার্লো। ২০১৮ সালে তিনি “ফেয়ারবিএনবি” নামে একটি প্ল্যাটফর্ম চালু করেন, যেখানে শুধুমাত্র স্থানীয় বাসিন্দাদের মালিকানাধীন ভ্যাকেশন রেন্টাল-এর ব্যবস্থা রয়েছে। ভেনিস থেকে মূল ভূখণ্ডে (প্রায় ১০ মিনিটের ট্রেন যাত্রা) বাসিন্দাদের চলে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো, শহরে বাসস্থানের অভাব।

বর্তমানে, এয়ারবিএনবি-তে ৮,৩২২ টি তালিকাভুক্তির মধ্যে ৭৭ শতাংশই পুরো বাড়ি। ডাল কার্লো মনে করেন, “ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রতি আমাদের কোনো আপত্তি নেই, তবে যদি আপনি শুধুমাত্র পর্যটকদের জন্য ২০টি বাড়ি ভাড়া দেন, তাহলে আপনি আপনার সম্প্রদায়ের জন্য সমস্যা তৈরি করছেন।”

এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ভাড়ার অর্ধেক অর্থ স্থানীয় প্রকল্পে ব্যয় করা হয়। ডাল কার্লো সতর্ক করে বলেন, “একটা সময় আসবে যখন ভেনিসের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। আপনি যদি একবার এই জায়গার পরিবর্তন করে ফেলেন, তবে তা আর ফিরে আসবে না।”

ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার জন্য অনেকে কাজ করে যাচ্ছেন। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন এলেনা আলমানসি। তিনি “ভগা আলা ভেনেতা” নামক একটি ঐতিহ্যবাহী নৌকায় দাঁড় বাইবার কৌশল অনুশীলন করেন, যা কয়েক শতাব্দী ধরে ভেনিসের মানুষ উপহ্রদে চলাচলের জন্য ব্যবহার করে আসছেন।

এছাড়াও, তিনি “রোয়িং ভেনিস” নামক একটি প্রকল্পের মাধ্যমে পর্যটকদের জন্য নৌকায় ভ্রমণের ব্যবস্থা করেন, যা শহরের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে।

ম্যাতেও সিলভারিও নামের একজন উদ্যোক্তা “রিহাব” নামে একটি স্টার্টআপ শুরু করেছেন। তিনি মুরানোতে কাঁচের জিনিস তৈরির সময় যে বর্জ্য তৈরি হয়, তা পুনর্ব্যবহার করে ত্রিমাত্রিক (থ্রিডি) প্রিন্টারের মাধ্যমে নানান শিল্পকর্ম তৈরি করেন।

মিশেলা বোরতোলোজি নামের একজন ডিজাইনার, যিনি একসময় বিদেশে থাকতেন, করোনা মহামারীর সময় নিজের শহরে ফিরে আসেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, এখানে টিকে থাকতে হলে স্থানীয় সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

তাই তিনি “রিলাইট ভেনিস” নামে একটি দোকান খোলেন, যেখানে তিনি ভেনিসীয় গথিক স্থাপত্যের নকশা করা মোমবাতি এবং সাবান তৈরি করেন। তাঁর মতে, “ভেনিস আমার পণ্যের মতোই সুন্দর—আরো অনেক বেশি। ভেনিসকে ধ্বংস করবেন না, কারণ আমরা এটি পুনরায় তৈরি বা কিনতে পারব না।”

তবে, ভেনিসকে বাঁচানো যাবে কিনা, তা নিয়ে অনেকের মনেই সন্দেহ রয়েছে। ওয়ারচেস্টার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ভেনিস প্রজেক্ট সেন্টারের পরিচালক ফ্যাবিও ক্যারেরা মনে করেন, “পর্যটনের কার্ডটি অতিরিক্ত ব্যবহার করা হয়েছে এবং এখন কিছু সংস্কারের প্রয়োজন।”

তিনি সম্প্রতি ম্যালোর্কা এবং ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের মতো স্থানগুলোতে স্থানীয় সম্প্রদায়ের প্রতিবাদের উদাহরণ দেন। ক্যারেরা মনে করেন, শহরের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি প্রয়োজন।

ডাল কার্লোর মতে, পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত নয় এমন মানুষদের ভেনিসে বসবাসের জন্য আকৃষ্ট করা জরুরি। “আমি মনে করি, আমাদের এমন লোকজনকে আকৃষ্ট করতে হবে, যারা বুদ্ধিমান এবং উদ্যোক্তা। কারণ, এটি এই শহরের ডিএনএ-তে রয়েছে।” বোরতোলোজি মনে করেন, দায়িত্বশীল পর্যটন এক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে।

ভেনেটিয়ার কার্পেন্টার এবং ক্যালফাতির “সোসাইটি অফ মিউচুয়াল এইড” এর প্রেসিডেন্ট সিজারে পেরিস মনে করেন, ভেনিসকে বাঁচাতে হয়তো অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাঁর মতে, “যদি আপনি ভেনিসের পর্যটকদের এমন একটি উপায় খুঁজে পান যা শহরটিকে ধ্বংস করবে না, তাহলে আমরা হয়তো বিশ্বের সব শহরের জন্য একটি পদ্ধতি খুঁজে পাব।”

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *