জীবনদায়ী অঙ্গ প্রতিস্থাপন: এক ঐতিহাসিক পর্যালোচনা
অঙ্গ প্রতিস্থাপন চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি, যা জীবন বাঁচানোর সম্ভাবনা নিয়ে আসে। বর্তমানে এটি একটি সাধারণ প্রক্রিয়া হলেও, কয়েক দশক আগেও বিষয়টি ছিল কেবল পরীক্ষামূলক।
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে এই পদ্ধতিতে এসেছে বিপুল পরিবর্তন, যা মানুষের জীবনকে করেছে আরও উন্নত। সম্প্রতি, পশু থেকে মানুষের শরীরে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের (xenotransplantation) সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে, যা চিকিৎসা জগতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
একুশ শতকের শুরুতে, ফরাসি চিকিৎসক ড. ম্যাথিউ জাবুলে (Dr. Mathieu Jaboulay) পশু অঙ্গ মানবদেহে প্রতিস্থাপনের প্রথম দিকের চেষ্টাগুলোর মধ্যে অন্যতম করেন। ১৯০৬ সালে তিনি এক নারীর কনুইয়ে একটি শূকরের কিডনি স্থাপন করেন।
যদিও এই কিডনিটি বেশিদিন কাজ করতে পারেনি, তবে এটি ছিল এই ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষার প্রথম দিকের একটি। মানুষের অঙ্গের অভাব পূরণের জন্য পশু অঙ্গের ব্যবহার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে ১৯৫৪ সাল একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। বোস্টনের ব্রিগহাম অ্যান্ড উইমেনস হাসপাতালে ড. জোসেফ ই. মারে (Dr. Joseph E. Murray) প্রথমবারের মতো সফলভাবে মানুষের শরীরে অঙ্গ প্রতিস্থাপন করেন।
তিনি যমজ ভাই রিচার্ডের শরীরে তার ভাই রোনাল্ডের কিডনি প্রতিস্থাপন করেন। যেহেতু তারা জমজ ছিলেন, তাই রিচার্ডের শরীর নতুন অঙ্গটিকে গ্রহণ করে, ফলে কোনো জটিলতা হয়নি।
এই সাফল্যের পর অঙ্গ প্রতিস্থাপন চিকিৎসা দ্রুতগতিতে এগিয়ে যায়।
পরবর্তীতে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমানোর ওষুধ আবিষ্কারের ফলে অঙ্গ প্রতিস্থাপন আরও সহজ হয়ে যায়। ১৯৬০-এর দশকে, ড. মারে পরীক্ষামূলকভাবে দেখান যে, প্রতিস্থাপনের পর রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমানোর ওষুধ প্রয়োগ করলে সফলতার সম্ভাবনা বাড়ে।
১৯৬২ সালে তিনি একজন মৃত ব্যক্তির কিডনি অন্য একজন মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপন করেন এবং রোগী এক বছরের বেশি সময় ধরে সুস্থ ছিলেন।
এই সময়ে, ব্রেইন ডেথ বা মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বন্ধ হয়ে যাওয়াকে মৃত্যুর নতুন সংজ্ঞা হিসেবে ধরা হয়। এর ফলে, মৃত ব্যক্তির অঙ্গ সংগ্রহ করা সহজ হয় এবং প্রতিস্থাপনের সংখ্যাও বাড়ে।
ধীরে ধীরে কিডনির পাশাপাশি যকৃত, অগ্ন্যাশয় এবং হৃদযন্ত্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ প্রতিস্থাপনও শুরু হয়। ১৯৬৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার সার্জন ড. ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ড (Dr. Christiaan Barnard) প্রথম হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন করেন।
অঙ্গ প্রতিস্থাপনে নতুন দিগন্ত উন্মোচন হয় ১৯৯০-এর দশকে, যখন সাইক্লোস্পোরিন (cyclosporine) এবং ট্যাক্রোলিমাস (tacrolimus) এর মতো নতুন রোগ প্রতিরোধক ঔষধ আবিষ্কার হয়।
১৯৯৮ সালে ফ্রান্সে প্রথম হাতের সফল প্রতিস্থাপন হয়। এরপর মুখ এবং শরীরের অন্যান্য অংশের সফল প্রতিস্থাপনও হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, জেনেটিক প্রযুক্তি (genetic technology) এবং জিন সম্পাদনার (gene editing) মাধ্যমে শূকরের অঙ্গ মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপনের চেষ্টা চলছে। CRISPR-এর মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে শূকরের ডিএনএ পরিবর্তন করা হচ্ছে, যাতে মানবদেহে অঙ্গ প্রত্যাখ্যানের ঝুঁকি কমানো যায়।
২০২১ সালে, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণা কেন্দ্রে, মস্তিষ্কের মৃত রোগীর শরীরে একটি জিনগতভাবে পরিবর্তিত শূকরের কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়, যা সফল হয়।
২০২২ সালে, মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসকেরা প্রথম জীবিত ব্যক্তির শরীরে শূকরের হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন করেন।
বর্তমানে, বিজ্ঞানীরা মানুষের জন্য উপযোগী অঙ্গ তৈরির জন্য গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে রয়েছে, শূকরের অঙ্গকে কাঠামো হিসেবে ব্যবহার করে মানুষের স্টেম সেল দিয়ে নতুন অঙ্গ তৈরি করা অথবা ত্রিমাত্রিক (3D) পদ্ধতিতে অঙ্গ তৈরি করা।
অঙ্গ প্রতিস্থাপন একটি জটিল প্রক্রিয়া, তবে এর মাধ্যমে মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব। ভবিষ্যতে, এই চিকিৎসা আরও উন্নত হবে এবং অঙ্গের অভাবও হয়তো দূর করা যাবে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন