গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় হাসপাতালগুলোর উপর্যুপরি আঘাত, মানবিক বিপর্যয় চরম আকার ধারণ করেছে। অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনী হাসপাতালের ওপর হামলা অব্যাহত রাখায় সেখানকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।
আল জাজিরার সংবাদে জানা যায়, উত্তর গাজায় আংশিকভাবে চালু থাকা ইন্দোনেশিয়ান হাসপাতালকে লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা চালানো হয়েছে। একই সঙ্গে, বোমাবর্ষিত অঞ্চলের উত্তরে ও দক্ষিণে স্থল অভিযানও চালাচ্ছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী।
আল-শিফা হাসপাতালের পরিচালক ড. মোহাম্মদ আবু সালমিয়া জানান, শনিবার থেকে শুরু হওয়া হামলাগুলো গাজার হাসপাতালগুলোর ওপর ইসরায়েলি আগ্রাসন তীব্র হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, “চিকিৎসা কর্মীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আমাদের হাতে সীমিত সংখ্যক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন এবং বিপুল সংখ্যক মানুষের জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন।”
ইন্দোনেশিয়ান হাসপাতালটি উত্তর গাজার প্রধান চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। হাসপাতালটি কার্যত অচল হয়ে পড়ায় রোগীদের জীবন বাঁচানোর সম্ভাবনা কমে গেছে। ড. আবু সালমিয়ার আশঙ্কা, এতে হাজার হাজার রোগী মারা যেতে পারে।
জরুরি ভিত্তিতে রক্ত সরবরাহ করারও আহ্বান জানানো হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে, ইসরায়েলি বাহিনী বেইত লাহিয়ার হাসপাতালটি ঘিরে ফেলেছে, যার ফলে সেখানে আতঙ্ক ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে।
মন্ত্রণালয় আরও জানায়, ইসরায়েল রোগী ও কর্মীদের হাসপাতালে প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে, যার ফলে হাসপাতালটি কার্যত পরিষেবা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। তাদের মতে, ইন্দোনেশিয়ান হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উত্তর গাজার সকল সরকারি হাসপাতাল বর্তমানে পরিষেবা দিতে পারছে না।
গত ১৮ মাস ধরে চলা ইসরায়েলি হামলায় গাজার স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো বারবার আক্রান্ত হয়েছে। যুদ্ধের শুরু থেকে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী কামার আদওয়ান হাসপাতাল, আল-শিফা হাসপাতাল, আল-আহলি হাসপাতাল এবং আল-আওদা হাসপাতালের মতো উত্তর অঞ্চলের অন্যান্য হাসপাতালগুলোতেও বোমা হামলা চালিয়েছে, যা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং অবরোধ করা হয়েছে।
এছাড়াও, ডজন খানেক চিকিৎসা কেন্দ্র, স্টেশন ও অ্যাম্বুলেন্সও হামলার শিকার হয়েছে। ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, চিকিৎসা কর্মী ও রোগীদের ওপর হামলা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
গাজার কেন্দ্র ও দক্ষিণাঞ্চলেও ইসরায়েল বেশ কয়েকটি হাসপাতালে হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে দেইর আল-বালাহ-এর আল-আকসা হাসপাতাল এবং খান ইউনিসের নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্স অন্যতম। চলতি সপ্তাহের শুরুতে খান ইউনিসে দুটি হাসপাতালে হামলা চালানো হয়।
ইউরোপীয় গাজা হাসপাতালের উঠানে ন’টি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে, এতে কমপক্ষে ১৬ জন নিহত হয়েছে। নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সে হামলায় এক আহত সাংবাদিকসহ দুইজন নিহত হন।
গাজার স্বাস্থ্যখাতে লাগাতার হামলার কারণে সেখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে এবং স্বাভাবিক কার্যক্রম চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, সাধারণ রোগের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ঔষধের অভাব রয়েছে।
নিরবচ্ছিন্ন অবরোধের কারণে হাসপাতালগুলো প্রায় ভেঙে পড়েছে, যেখানে ইসরায়েল প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রী, জ্বালানি এবং খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির মতো মানবিক সহায়তা প্রবেশ করতে বাধা দিচ্ছে। মানবিক কর্মকর্তারা সতর্ক করেছেন, গাজায় সংকট সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
গত ৭২ ঘন্টায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় শত শত ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। দেয়ার আল-বালাহ থেকে আল জাজিরার প্রতিবেদক হিন্দ খৌদারি জানিয়েছেন, কয়েক ডজন ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন এবং চিকিৎসকেরা বলছেন, “চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে তারা আহতদের চিকিৎসা করতে নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।”
লন্ডনভিত্তিক একটি স্বাধীন সংস্থা এয়ারওয়ার্স-এর নির্বাহী পরিচালক এমিলি ট্রিপ জানান, সাম্প্রতিক সংঘাতের প্রাথমিক তথ্য অনুসারে, এপ্রিল মাসে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত একজন নিহত বা আহত হওয়ার ঘটনা প্রায় ৭০০-এর কাছাকাছি ছিল। যা কেবল ২০২৩ সালের অক্টোবর বা ডিসেম্বরের সঙ্গে তুলনীয় ছিল, যা বোমা হামলার সবচেয়ে ভয়াবহ সময় ছিল।
জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)-এর হিসাব অনুযায়ী, গত ১০ দিনে ইসরায়েলি বিমান হামলায় প্রতিদিন গড়ে ১০০ জন শিশু নিহত বা আহত হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের হামলায় নিহত প্রায় ৫৩,০০০ জনের মধ্যে প্রায় ৩,০০০ জন গত ১৮ মার্চ থেকে ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ভেঙে দেওয়ার পর নিহত হয়েছেন।
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ফিলিস্তিনি চিলড্রেনস রিলিফ ফান্ডের একজন স্বেচ্ছাসেবী ফার্মাসিস্ট, যিনি গাজা শহরে হামলায় পরিবারের সঙ্গে নিহত হন। আল আওদা স্বাস্থ্য ও কমিউনিটি অ্যাসোসিয়েশনের একজন মিডওয়াইফও ৭ মে অন্য একটি হামলায় পরিবারের সঙ্গে নিহত হয়েছেন।
এছাড়াও কাতারভিত্তিক টেলিভিশন নেটওয়ার্ক আল-আরাবি টিভির একজন সাংবাদিক ও তার পরিবারের ১১ জন সদস্য নিহত হয়েছেন। তথ্য সূত্র: আল জাজিরা