শিরোনাম: স্মার্টফোন আর আধুনিকতার পেছনে: কঙ্গোর খনি শ্রমিকদের জীবনযুদ্ধ।
আফ্রিকার দেশ কঙ্গো, যেখানে খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য্য, সেখানেই যেন লুকিয়ে আছে এক গভীর বেদনা। দেশটির পূর্বাঞ্চলে, মাসিসি অঞ্চলের সবুজ পাহাড়ের কোলে অবস্থিত রুবাবা খনি।
সেখানে দিনরাত কাজ করে চলা মানুষগুলোর দিকে তাকালে চোখে পড়ে চরম দারিদ্র্যের চিত্র। আধুনিক প্রযুক্তির দুনিয়ায় কলটান নামক একটি মূল্যবান খনিজ পদার্থের চাহিদা বাড়ছে, আর এই কলটান উত্তোলনের কাজটি করেন রুবাবা খনির শ্রমিকেরা, যাদের জীবন যুদ্ধের অন্য নাম।
কলটান আসলে কলম্বাইট-ট্যানটালাইটের সংক্ষিপ্ত রূপ। এই খনিজ থেকে ট্যানটালাম ও নিওবিয়াম নামের দুটি ধাতু পাওয়া যায়, যা মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, গাড়ির যন্ত্রাংশ থেকে শুরু করে যুদ্ধ বিমানের ইঞ্জিন—আধুনিক জীবনের অত্যাবশ্যকীয় সব উপকরণ তৈরিতে লাগে।
উন্নত দেশগুলোতে যখন স্মার্টফোন আর অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে হইচই চলছে, তখন কঙ্গোর এই শ্রমিকদের জীবন যেন এক গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত।
কঙ্গোতে কলটান খনি শ্রমিকদের জীবনযাত্রা অত্যন্ত কষ্টের। এখানকার শ্রমিকদের দৈনিক আয় শুনলে হয়তো অনেকেই আঁতকে উঠবেন।
সাত বছর ধরে খনিতে কাজ করা জঁ-ব্যাপটিস্ট বিগিবিমানা জানান, “আমি মাসে মাত্র ৪০ ডলার (প্রায় ৪,৫০০ টাকা) রোজগার করি। এই সামান্য টাকায় বাচ্চাদের কাপড়, শিক্ষা ও খাবারের খরচ জোগানো সম্ভব হয় না।”
কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে দশকের পর দশক ধরে চলা সশস্ত্র সংঘাত এখানকার পরিস্থিতি আরও কঠিন করে তুলেছে। সরকারি বাহিনী এবং এম২৩ বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষ বাঁধে।
এই সংঘাতের কারণে উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে মানবিক সংকট। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো খনিগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য প্রায়ই হামলা চালায়।
রুবাবা খনিও এর ব্যতিক্রম নয়। একসময় এম২৩ বিদ্রোহীরা এই খনি নিজেদের দখলে নিয়েছিল। তাদের এই দখলের কারণে কলটান ব্যবসার ওপর কর বসানো হয়, যা থেকে তারা প্রতি মাসে প্রায় আট লক্ষ ডলার আয় করত।
কঙ্গোর খনিজ সম্পদের বিশাল ভান্ডার থাকা সত্ত্বেও, এখানকার ৭০ শতাংশেরও বেশি মানুষ দিনে ২.১৫ ডলারেরও কম আয় করে, যা বাংলাদেশের অনেক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চেয়েও খারাপ। কলটান খনিগুলোতে কাজ করা শ্রমিকদের জীবনযাত্রা চরম দারিদ্র্যের মধ্যে অতিবাহিত হয়।
বর্তমানে, কঙ্গো সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি চুক্তির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে, যেখানে খনিজ সম্পদের বিনিময়ে নিরাপত্তা সহায়তা প্রদানের কথা বলা হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই চুক্তির আওতায় রুবাবা খনিও আসতে পারে।
কিন্তু এখানকার শ্রমিকদের জীবনযাত্রার কোনো পরিবর্তন হবে কিনা, তা এখনো অনিশ্চিত।
বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ কলটান কঙ্গোতেই উৎপাদিত হয়। এর বাইরে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও ব্রাজিলের মতো দেশগুলোও কলটানের গুরুত্বপূর্ণ যোগানদাতা।
উন্নত দেশগুলোতে যখন কলটানের চাহিদা বাড়ছে, তখন রুবাবা খনির শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তাদের ন্যায্য মজুরি, উন্নত কর্মপরিবেশ এবং শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা না হলে, আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগেও তারা চরম দারিদ্র্যের শিকার হয়েই থাকবে।
রুবাবা খনির কলটান ব্যবসায়ী বাহাতি মইসের কথাগুলো যেন সেখানকার শ্রমিকদের প্রতিচ্ছবি। তিনি বলেন, “সারা বিশ্ব জানে, আমাদের খনিজ থেকে তৈরি হয় মোবাইল ফোন, কিন্তু আমাদের জীবনযাত্রা দেখুন! এভাবে আর কত দিন?”
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা