চীনের ‘বিরল মৃত্তিকা’ খনিজ পদার্থের নিয়ন্ত্রণ: যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্য চুক্তির পরেও কি বদলাচ্ছে পরিস্থিতি?
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ বন্ধ করতে একটি ৯০ দিনের চুক্তিতে রাজি হলেও, চীন সম্ভবত তাদের ‘বিরল মৃত্তিকা’ (rare earth) খনিজ পদার্থের রফতানির ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখছে।
এই পদক্ষেপের মাধ্যমে তারা ভবিষ্যৎ আলোচনাগুলোতে দর কষাকষির ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইছে, যা ওয়াশিংটনের সঙ্গে তাদের কৌশলগত প্রতিযোগিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
গত সপ্তাহে জেনেভায় শুল্ক কমানোর বিষয়ে একটি বাণিজ্য চুক্তি হয়, যেখানে চীন ২ এপ্রিল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের উপর আরোপিত ‘অ-শুল্ক’ ব্যবস্থা স্থগিত বা অপসারণ করতে রাজি হয়েছিল।
কিন্তু এরপরেও, ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা জানতে চাইছে যে চীনের এই প্রতিশ্রুতি ৭টি বিরল মৃত্তিকা খনিজ পদার্থ এবং সংশ্লিষ্ট পণ্যের রফতানি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কিনা।
কারণ, এই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাটি গত ৪ এপ্রিল থেকে কার্যকর করা হয়েছিল, যা ছিল চীনা পণ্যের উপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘পাল্টা’ শুল্কের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ।
এই বিরল মৃত্তিকা উপাদানগুলি থেকে তৈরি চুম্বক (magnets) বিভিন্ন জিনিসের জন্য অপরিহার্য।
উদাহরণস্বরূপ, আইফোন (iPhone) এবং বৈদ্যুতিক গাড়ি থেকে শুরু করে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার মতো অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম তৈরিতেও এর ব্যবহার হয়।
কিন্তু এর সরবরাহ এখনো পর্যন্ত মূলত চীনের হাতেই কেন্দ্রীভূত।
জেনেভার বাণিজ্য আলোচনা থেকে ফিরে আসার পর, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি জ্যামিসন গ্রিয়ার (Jamieson Greer) এই সম্ভাব্য দুর্বলতা সম্পর্কে উদ্বেগ কমাতে চেয়েছিলেন।
তিনি একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে জানান, চীন বিরল মৃত্তিকা রফতানির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে রাজি হয়েছে।
তবে, বিশেষজ্ঞদের মতে, চীন তাদের নতুন রফতানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা শিথিল করার কোনো লক্ষণ দেখাচ্ছে না।
বরং, তারা এই ব্যবস্থা আরও জোরদার করছে বলেই মনে হচ্ছে।
এপ্রিল মাসে চালু হওয়া এই পদ্ধতিতে সরাসরি রফতানি নিষিদ্ধ করা হয়নি, তবে প্রতিটি চালানের জন্য সরকারের অনুমোদনের প্রয়োজন।
এর ফলে কোম্পানিগুলোকে নতুন নিয়মের সঙ্গে মানিয়ে নিতে বেশ কয়েক সপ্তাহ লেগে যায়, যা বিভিন্ন মার্কিন শিল্প, যেমন – স্বয়ংচালিত এবং প্রতিরক্ষা শিল্পে উদ্বেগের সৃষ্টি করে।
টরোন্টো-ভিত্তিক শিল্প পরামর্শক সংস্থা স্টর্মক্রো ক্যাপিটালের (Stormcrow Capital) প্রেসিডেন্ট জন হাইকাউই (Jon Hykawy) বলেন, “আমার মনে হয়, গ্রিয়ার সম্ভবত যা হওয়ার আশা করছেন, সে কথা বলছেন, বাস্তবে যা আলোচনা হয়েছে, সে কথা নয়।”
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (CSIS) ক্রিটিক্যাল মিনারেলস সিকিউরিটি প্রোগ্রামের পরিচালক গ্রেসেলিন বাসকারান (Gracelin Baskaran) বলেছেন, চীনের রফতানি লাইসেন্সিং ব্যবস্থা ‘এখানেই থাকবে’ এবং ‘দীর্ঘকাল ধরে থাকতে পারে’, যা বেইজিংকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভবিষ্যৎ বাণিজ্য আলোচনায় সুবিধা দেবে।
যদি যুক্তরাষ্ট্র তাদের শুল্ক নীতি পরিবর্তন করে, তাহলে চীন সহজেই প্রয়োজনীয় লাইসেন্স দিতে অস্বীকার করতে পারে।
এই লাইসেন্সিং নীতি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যা বেইজিংকে যেকোনো সময়ে তাদের বিরল মৃত্তিকা খনিজ এবং চুম্বকগুলি কোন কোম্পানি বা দেশকে সরবরাহ করা হবে, তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা দেয়।
জেনেভা আলোচনার পর, চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ২৮টি মার্কিন কোম্পানিকে তাদের দ্বৈত-ব্যবহার রফতানি নিয়ন্ত্রণ তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে এবং আরও ১৭টি আমেরিকান কোম্পানিকে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ তালিকা থেকেও সরিয়ে দিয়েছে।
তবে, বিরল মৃত্তিকা খনিজ ও চুম্বক রফতানির নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কোনো পরিবর্তনের কথা তারা উল্লেখ করেনি।
চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র গত শুক্রবার এক নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে জানান, চীন রফতানি নিয়ন্ত্রণ শিথিল করছে কিনা, সে বিষয়ে তার কাছে কোনো তথ্য নেই।
বরং, চীনা কর্তৃপক্ষ কৌশলগত খনিজ পদার্থের চোরাচালানের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে।
এই খনিজগুলির মধ্যে বিরল মৃত্তিকা উপাদানও অন্তর্ভুক্ত।
১২ মে, যেদিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন শুল্ক কমানোর ঘোষণা দেয়, সেদিন চীনের রফতানি নিয়ন্ত্রকরা বেশ কয়েকটি খনিজ সমৃদ্ধ প্রদেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে।
এই বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল ‘কৌশলগত খনিজ পদার্থের অবৈধ বহির্গমন রোধ করা’ এবং ‘উৎপাদন ও সরবরাহ শৃঙ্খলের প্রতিটি ক্ষেত্রে তদারকি জোরদার করা’।
একই দিনে, রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম সি সি টি ভি’র (CCTV) সঙ্গে যুক্ত একটি সামাজিক মাধ্যম অ্যাকাউন্ট, ইউয়ুয়ান তানতিয়ান (Yuyuan Tantian) একটি পোস্টে জানায়, “চীনের বিরল মৃত্তিকা রফতানি নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত আছে।”
এদিকে, কয়েক সপ্তাহ বিলম্বের পর, চীন বিরল মৃত্তিকা চুম্বক রফতানির জন্য লাইসেন্স দেওয়া শুরু করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর থেকে বোঝা যায় যে নতুন লাইসেন্সিং ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে, কিন্তু রফতানি সহজ করা হচ্ছে না।
দুজন চীনা বিরল মৃত্তিকা চুম্বক প্রস্তুতকারক সিএনএনকে (CNN) জানিয়েছে, তারা সম্প্রতি ডিসপ্রোশিয়াম (dysprosium) এবং টারবিয়াম (terbium) -এর মতো উপাদানযুক্ত পণ্য রফতানির জন্য লাইসেন্স পেয়েছে।
এই উপাদানগুলি সাধারণত উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন চুম্বক তৈরিতে ব্যবহার করা হয়, যা স্বয়ংচালিত, মহাকাশ ও সামরিক শিল্পে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, এই অনুমোদনগুলি ‘এক চালান, এক লাইসেন্স’ নীতিতে দেওয়া হচ্ছে, অর্থাৎ প্রতিটি চালানের জন্য নতুন লাইসেন্স প্রয়োজন এবং এটি পুনরায় ব্যবহার করা যায় না।
তাদের মধ্যে একটি কোম্পানি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি চালানের জন্য প্রথম রফতানি লাইসেন্স পেয়েছে।
এরপর জার্মানির গাড়ি প্রস্তুতকারক ফক্সওয়াগেনসহ ইউরোপে রফতানির জন্য আরও কয়েকটি লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।
কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত একজন ব্যক্তি সিএনএনকে বলেছেন, “আমরা রফতানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সহজ করার কোনো ইঙ্গিত পাইনি।”
ফক্সওয়াগেন এক বিবৃতিতে বলেছে যে, তাদের সরবরাহকারীরা জানতে পেরেছে যে “সীমিত সংখ্যক রফতানি লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।”
সিএসআইএসের বাসকারান বলেছেন, বিরল মৃত্তিকা রফতানি নিয়ন্ত্রন শিথিল করার পরিবর্তে চীন তাদের রফতানি নিয়ন্ত্রণ তালিকা থেকে ২৮টি মার্কিন কোম্পানিকে সরিয়ে দিয়েছে।
এর মানে হল, সেই কোম্পানিগুলো, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই মহাকাশ ও প্রতিরক্ষা শিল্পের সঙ্গে জড়িত, তারা এখন চীন থেকে দ্বৈত-ব্যবহারের উপকরণ পেতে পারবে এবং তাদের চীনা সরবরাহকারীরা এখন বিরল মৃত্তিকা চুম্বকের রফতানির জন্য লাইসেন্সের আবেদন করতে পারবে।
তবে, বেইজিং শেষ পর্যন্ত মার্কিন প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলোকে লাইসেন্স দেবে কিনা, তা এখনো দেখার বিষয়।
সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক খনিজ ও ধাতু সরবরাহ শৃঙ্খল সংস্থা জিঞ্জার ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের পরিচালক থমাস ক্রুয়েমার (Thomas Kruemmer) বলেছেন, চীনের বিরল মৃত্তিকা রফতানি নিয়ন্ত্রণগুলি ‘বিশেষভাবে মার্কিন প্রতিরক্ষা শিল্পকে আঘাত করার জন্য তৈরি করা হয়েছে এবং আমি মনে করি না চীন এই বিষয়ে কোনো ছাড় দেবে।’
নতুন নিয়মানুসারে, রফতানিকারকদের তাদের আবেদনে চূড়ান্ত ব্যবহারকারীর তথ্য অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যা অনুমোদন হতে প্রায় ৪৫ কার্যদিবস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
ক্রুয়েমার আরও বলেন, “আমি নিশ্চিত যে প্রতিরক্ষা ঠিকাদারদের ক্ষেত্রে, চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কিছু কঠিন প্রশ্ন করবে, যা আমেরিকানরা হয়তো উত্তর দিতে চাইবে না বা পেন্টাগনের অনুমতি নিতে হবে।”
এইভাবে তারা দ্বৈত-ব্যবহার পণ্য রফতানির লাইসেন্স ইস্যু করতে বিলম্ব করতে পারে, সম্ভবত এই ৯০ দিনের (চুক্তি) সময়সীমার পরেও।
এমনকি তারা লাইসেন্স আবেদন প্রত্যাখ্যান করারও সুযোগ পাবে।
লাইসেন্সিং নিয়ম চীনকে বিরল মৃত্তিকা চুম্বকগুলি কোথায় শেষ পর্যন্ত ব্যবহৃত হচ্ছে, সে সম্পর্কে ধারণা পেতে সাহায্য করতে পারে।
সেন্ট লুই, মিসৌরির (Missouri) একটি বিরল মৃত্তিকা পরামর্শদাতা সংস্থা থ্রি কনসাল্টিংয়ের (Three Consulting) প্রেসিডেন্ট জেমস কেনেডি (James Kennedy) বলেন, “আপনি এখনো মালপত্র পেতে পারেন, তবে আপনাকে কাগজপত্র পূরণ করতে হবে এবং চীনে জানাতে হবে যে চূড়ান্ত ব্যবহারকারী কারা।
আপনি এই সমস্ত তথ্য দেবেন এবং তারপর (চীন) আপনার গ্রাহক বেস এবং তাদের ব্যবহার সম্পর্কে জানতে পারবে এবং আরও দুর্বলতা খুঁজে বের করতে পারবে।”
সুতরাং, এটি খুবই স্মার্ট।
তারা আপনার কাজকর্মের উপর নজর রাখতে পারবে।”
যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশ দীর্ঘদিন ধরে চীনের বিরল মৃত্তিকা খনিজ সরবরাহের উপর নির্ভরশীল।
এই খনিজগুলি উত্তোলন ও প্রক্রিয়াকরণ কঠিন, ব্যয়বহুল এবং পরিবেশ দূষণকারী।
আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থার (International Energy Agency) তথ্য অনুসারে, চীন বিশ্বব্যাপী উৎপাদিত বিরল মৃত্তিকার ৬১% উৎপাদন করে এবং প্রক্রিয়াকরণ পর্যায়ে এর নিয়ন্ত্রণ বিশ্ব বাজারের ৯২%।
এপ্রিলের রফতানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বেইজিংয়ের প্রভাবশালী অবস্থানের প্রথম উদাহরণ নয়।
২০১০ সালে, চীন একটি আঞ্চলিক বিরোধের জেরে প্রায় দুই মাস ধরে জাপানে বিরল মৃত্তিকা সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল।
২০২৩ সালের শেষের দিকে, তারা বিরল মৃত্তিকা নিষ্কাশন ও পৃথকীকরণ প্রযুক্তির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
এছাড়াও, বেইজিং অর্থনীতি ও বিশ্ব সরবরাহ শৃঙ্খলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য কৌশলগত খনিজ পদার্থের রফতানিও কমিয়ে দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে গ্যালিয়াম, জার্মেনিয়াম, অ্যান্টিমনি এবং তথাকথিত সুপারহার্ড (superhard) উপাদানের উপর সরাসরি নিষেধাজ্ঞা।
কেনেডি বলেন, “বিরল মৃত্তিকা, কোবাল্ট, গ্যালিয়াম এবং এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ উপকরণগুলির উপর চীনের নিয়ন্ত্রণ আগে কখনো দেখা যায়নি এবং এটি একটি ভূ-রাজনৈতিক অস্ত্র।”
“এবং সবশেষে, এটি অনেক অনিশ্চয়তা তৈরি করে।
আর এটি নিজেই একটি শক্তিশালী অস্ত্র।”
বাসকারান বলেছেন, ফক্সওয়াগেনকে বিরল মৃত্তিকা চুম্বকের প্রথম কিছু রফতানি লাইসেন্স দেওয়ার মাধ্যমে, চীন একটি সুস্পষ্ট ভূ-রাজনৈতিক বার্তা পাঠাচ্ছে।
তিনি বলেন, “জার্মানি ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র জার্মানির চীনের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে অসন্তুষ্ট।
সুতরাং, চীন তাদের প্রথম লাইসেন্সগুলির মধ্যে একটি দিয়ে চীন-জার্মান সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক সংকেত দিচ্ছে।
বিশ্বের দুটি প্রধান শক্তির মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার এই যুগে, লাইসেন্সিং ব্যবস্থা ক্ষমতার বৃহত্তর রূপ হিসেবে টিকে থাকতে পারে।”
তথ্যসূত্র: সিএনএন