একবিংশ শতাব্দীতেও, আমেরিকার বুকে বিবর্তনবাদ এবং সৃষ্টিতত্ত্বের বিতর্ক যেন থামবার নয়। কেন হাম নামের এক ব্যক্তি বাইবেলের ‘নোহের নৌকা’র আদলে বিশাল এক কাঠামো তৈরি করেছেন, যা বিতর্ককে আরও উস্কে দিয়েছে।
এটি শুধু একটি কাঠামো নয়, বরং একটি জাদুঘরও বটে, যেখানে বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্বকে আক্ষরিক অর্থে তুলে ধরা হয়েছে।
কেনটাকি প্রদেশের উইলিয়ামসটাউনে অবস্থিত এই ‘আর্ক এনকাউন্টার’-এর বিশালতা যে কারো নজর কাড়ে। এটি প্রায় দেড়টা ফুটবল মাঠের সমান জায়গা জুড়ে বিস্তৃত।
কাঠনির্মিত এই বিশাল নৌকার ভেতরে রয়েছে বিভিন্ন প্রদর্শনী, যেখানে বাইবেলের নোহের প্লাবনের ঘটনার বাস্তব রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। হামের মূল উদ্দেশ্য হলো, বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্বের গল্পকে সত্য প্রমাণ করা।
তার মতে, পৃথিবীটা আসলে ৬,০০০ বছরের পুরনো এবং মানুষসহ সকল জীবজগৎ ঈশ্বরের সৃষ্টি।
তবে হামের এই ধারণা আধুনিক বিজ্ঞানীদের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীর বয়স কয়েক বিলিয়ন বছর এবং বিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জীবনের উদ্ভব হয়েছে।
এই বিতর্কের সূত্রপাত বহু আগে, ১৯২৫ সালের স্কোপস ট্রায়ালে। টেনেসির ডেটনে জন স্কোপস নামের এক শিক্ষককে বিবর্তনবাদ পড়ানোর জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছিল।
যদিও বিচার জেতেন রক্ষণশীলরা, কিন্তু জনমত ছিল বিবর্তনবাদের দিকে। কেন হাম মনে করেন, সেই সময়কার রক্ষণশীলরা তাদের মতবাদ দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি।
হামের মতে, বাইবেলের ব্যাখ্যা আক্ষরিক অর্থে করা উচিত। তিনি বিশ্বাস করেন, বাইবেলের প্রতিটি কথা সত্য।
এই বিশ্বাস থেকেই তিনি ‘আর্ক এনকাউন্টার’ তৈরি করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি মানুষকে বোঝাতে চান, বাইবেলের ইতিহাসই সত্য এবং সেই ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে গড়া হয়েছে সুসমাচার।
তবে হাম একা নন। আমেরিকায় এখনো অনেক মানুষ সৃষ্টিতত্ত্বে বিশ্বাসী। বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, দেশটির বেশ কিছু মানুষ মনে করেন, ঈশ্বরই মানুষকে তৈরি করেছেন এবং পৃথিবীর বয়স ১০,০০০ বছরের বেশি নয়।
এই সংখ্যাটা যদিও আগের তুলনায় সামান্য কমেছে, তবুও তা উল্লেখযোগ্য।
অন্যদিকে, বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বিবর্তনবাদ এবং পৃথিবীর বয়স সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেওয়া উচিত। তারা একে বিজ্ঞানের অপরিহার্য অংশ হিসেবে দেখেন।
এই বিতর্ক শুধু বিজ্ঞান আর ধর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। শিক্ষা ব্যবস্থায় এর প্রভাব রয়েছে।
অনেক রক্ষণশীল মনে করেন, স্কুলে বিবর্তনবাদের পরিবর্তে সৃষ্টিতত্ত্ব পড়ানো উচিত।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই ধরনের ধারণা শিশুদের মধ্যে ভুল বার্তা দেয়। তাদের মতে, পৃথিবীর বয়স ৪,০০০ বছর—এই ধারণা দেওয়াটা ভুল।
বিল নাইয়ের মতো বিজ্ঞানীরা এর তীব্র বিরোধিতা করেন।
বর্তমানে, ‘আর্ক এনকাউন্টার’-এর মতো আকর্ষণগুলি বছরে প্রায় ১৫ লক্ষ দর্শক আকর্ষণ করে। দর্শনার্থীরা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করতে এখানে আসেন।
তারা মনে করেন, বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্ব তাদের সন্তানদের জন্য একটি সঠিক পথ।
তবে, অনেক ধর্মীয় গোষ্ঠী বিবর্তনবাদকে গ্রহণ করেছে। তারা মনে করে, ঈশ্বরই বিবর্তন ঘটিয়েছেন।
অন্যদিকে, কিছু চরমপন্থী এখনো সৃষ্টিতত্ত্বে বিশ্বাসী।
সৃষ্টিকর্তা বিষয়ক এই বিতর্ক আসলে একটি বৃহত্তর সংস্কৃতির অংশ। সমালোচকদের মতে, এটি বিজ্ঞান, পরিবেশ এবং সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলে।
তাদের আশঙ্কা, এই ধরনের ধারণা জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সত্যকে অস্বীকার করতে পারে।
কেন হামের এই প্রকল্পগুলো ভবিষ্যতে আরও বিস্তৃত হওয়ার পরিকল্পনা করছে। তিনি চান, সৃষ্টিতত্ত্বের বার্তা আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে।
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস