যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে হামাসের সঙ্গে গোপনে আলোচনা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করছেন একজন মার্কিন-ফিলিস্তিনি।
গাজায় যুদ্ধ বন্ধের উদ্দেশ্যে হামাসের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। সূত্রের খবর, মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করছেন একজন মার্কিন-ফিলিস্তিনি নাগরিক। সম্প্রতি কাতারের রাজধানী দোহায় এই বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলের পদক্ষেপের উপর ক্রমশ অসন্তুষ্ট হচ্ছেন।
আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিযারা বাহবাহ। তিনি একজন মার্কিন-ফিলিস্তিনি, যিনি ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের হয়ে প্রচারণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। সূত্রের খবর, এর আগে এডান আলেকজান্ডার নামের একজন ইসরায়েলি-মার্কিন জিম্মিকে মুক্ত করতেও বাহবাহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
অন্যদিকে, হামাসের সঙ্গেও কাতারে আলোচনা শুরু করেছে ইসরায়েল। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে হামাসের সরাসরি যোগাযোগের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা হামাসের অবস্থান সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানতে পারছেন। অতীতে যুক্তরাষ্ট্র কাতার ও মিশরের মাধ্যমে হামাসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত।
বিষয়টি নিয়ে সাবেক মার্কিন দূত ডেনিস রস বলেন, “আমার মনে হয় তারা একটা ফলপ্রসূ আলোচনার দিকে এগোচ্ছে। তারা কাতার বা মিশরের মাধ্যমে নয়, বরং সরাসরি হামাসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চাইছে। এর মাধ্যমে তারা দ্রুত সমস্যাগুলো সমাধান করতে এবং হামাসকে প্রভাবিত করতে চাইছে।”
তবে কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বাহবাহের সীমিত অভিজ্ঞতা এবং হামাসের শীর্ষ নেতাদের গাজায় অবস্থানের কারণে এই আলোচনা ফলপ্রসূ নাও হতে পারে। তাদের মতে, এর মাধ্যমে ট্রাম্প ইসরায়েলকে এড়িয়ে চলতে চাইছেন।
কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের একজন সিনিয়র ফেলো, অ্যারন ডেভিড মিলার বলেন, “আমি নিশ্চিত নই, এটা কি হতাশার লক্ষণ, নাকি বিভ্রান্তি। সম্ভবত তারা হামাসের ভাবনা জানার একটা উপায় খুঁজছে।”
ট্রাম্প ও তার উপদেষ্টাদের মধ্যে ইসরায়েলের প্রতি অসন্তুষ্টির মূল কারণ হলো, প্রেসিডেন্ট দ্রুত এই যুদ্ধ বন্ধ করতে চান। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আলোচনার ধীরগতিতে ট্রাম্প বেশ বিরক্ত হয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ একজন ব্যক্তি সিএনএনকে জানিয়েছেন, “প্রেসিডেন্ট অবশ্যই একটি সমাধান চান। আলোচনা যত এগিয়ে যাচ্ছে, ততই স্পষ্ট হচ্ছে যে, [বেনিয়ামিন] নেতানিয়াহু সেভাবে প্রস্তুত নন।”
এদিকে, ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স সম্প্রতি ইতালি সফর শেষে ইসরায়েল যাননি। সূত্রের খবর, এর প্রধান কারণ ছিল লজিস্টিক সমস্যা। এছাড়া, সেখানে তাঁর উপস্থিতি ইসরায়েলের প্রতি সমর্থনের ইঙ্গিত দিতে পারত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “সেখানে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের নিরপেক্ষতা বজায় রাখা কঠিন হত। ইসরায়েলের কার্যক্রমের প্রতি এটি অতিরিক্ত সমর্থন হিসেবে দেখা হতো।”
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র ম্যাক্স ব্লুস্টেইন সিএনএনকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেছেন, “প্রশাসন ইসরায়েলের প্রতি অসন্তুষ্ট, এমন খবর সম্পূর্ণ মিথ্যা।”
তিনি আরও বলেন, “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের থেকে ভালো বন্ধু ইসরায়েলের আর কেউ ছিল না। আমরা আমাদের মিত্র ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি, যাতে গাজায় আটক জিম্মিদের মুক্তি নিশ্চিত করা যায়, ইরান কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে না পারে এবং আব্রাহাম চুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করা যায়।”
সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাম্প প্রশাসন কিছু ক্ষেত্রে ইসরায়েলের সরাসরি সমর্থন ছাড়াই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা, যেখানে ইসরায়েলের উপর কোনো হামলা হয়নি। এছাড়া, ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি নিয়েও আলোচনা চলছে, যেখানে ইসরায়েল ইরানের পরমাণু কর্মসূচির উপর হামলার পক্ষে।
ডেনিস রস বলেন, “সাম্প্রতিক বেশ কিছু পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে, যেখানে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে সবার আগে রাখছেন এবং ইসরায়েলের বিষয়গুলো তার কাছে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এর মানে এই নয় যে তিনি ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করছেন, বরং তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের প্রতি বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন।”
যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে সামনে রেখে, বিশেষ করে এই অঞ্চলে ট্রাম্প যে বিষয়গুলো এগিয়ে নিতে চান, সেগুলোর জন্য প্রশাসন গাজায় যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে চাইছে।
বাহবাহ বর্তমানে প্রেসিডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছেন। উইটকফ নেতানিয়াহু ও তার উপদেষ্টাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখছেন এবং উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতির জন্য একটি নতুন প্রস্তাব দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্র চায়, গাজায় মানবিক সহায়তা অব্যাহত থাকুক। ইসরায়েল ১১ সপ্তাহ ধরে গাজায় ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ করে রেখেছিল। রবিবার তারা অবশেষে এতে রাজি হয়।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারকো রুবিও বলেন, “ইসরায়েল হামাসকে পরাজিত করার লক্ষ্য অর্জন করতে পারে, একইসঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণে ত্রাণ সরবরাহ করতে পারে।”
রুবিও আরও বলেন, “আমরা সবাই একই ছবি দেখছি, যেখানে খাদ্য ও সহায়তা মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না।”
আলেকজান্ডারের মুক্তির জন্য হামাসের সঙ্গে হওয়া আলোচনাকে যুক্তরাষ্ট্র ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তা জানান, তারা এই পদক্ষেপকে ইসরায়েল ও হামাসকে আলোচনার টেবিলে ফেরানোর সুযোগ হিসেবে দেখছেন।
তবে এর কয়েক দিন পরই ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী গাজার উত্তরাঞ্চলে অভিযান শুরু করে। ইসরায়েল সতর্ক করে জানায়, হামাস জিম্মিদের মুক্তি দিতে রাজি না হলে এই অভিযান চালানো হবে।
সূত্র: সিএনএন