বিমান সংস্থাগুলির জন্য আসন্ন গ্রীষ্মকাল উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিমান ভ্রমণের চাহিদা হ্রাস পাওয়ার পেছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান। নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ, অর্থনৈতিক মন্দা এবং বিমানবন্দরের অব্যবস্থাপনা, সবমিলিয়ে আসন্ন গ্রীষ্মে বিমান সংস্থাগুলির ব্যবসায়ে বড় ধরনের ধাক্কা লাগতে পারে।
২০২৫ সালের শুরু থেকেই বিমান সংস্থাগুলো তাদের ব্যবসার প্রসারের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু যাত্রী চাহিদা কমে যাওয়ায় তাদের সেই পরিকল্পনা এখন প্রশ্নের মুখে। জানুয়ারী মাস থেকে যাত্রী নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রধান কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে।
এছাড়াও, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য যুদ্ধ এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক কারণে মার্কিন ডলারের মূল্য হ্রাস পাওয়ায় আমেরিকানদের জন্য বিদেশ ভ্রমণ আগের চেয়ে অনেক বেশি ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অন্যদিকে, ট্রাম্প প্রশাসনের কিছু সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে অথবা অভিবাসন সংক্রান্ত উদ্বেগের কারণে অনেক বিদেশি যাত্রী এখন ভ্রমণ করা থেকে বিরত থাকছেন। এছাড়াও, নিরাপত্তা সংক্রান্ত নতুন বিধিনিষেধের কারণে টিএসএ চেকপয়েন্টগুলি পার হতে যাত্রীদের ‘রিয়েল আইডি’ আপগ্রেড করার প্রয়োজন হচ্ছে। এতে অনেক যাত্রী হয়তো বিমানে ভ্রমণ করা থেকে বিরত থাকতে পারেন।
অর্থনৈতিক মন্দা তো আছেই। সব মিলিয়ে সাধারণত গ্রীষ্মকালে বিমান সংস্থাগুলি যে পরিমাণ মুনাফা করে থাকে, এবার হয়তো তাদের সেই লক্ষ্য পূরণ নাও হতে পারে। আমেরিকান ইকোনমিক লিবার্টিস প্রজেক্ট থিংক ট্যাঙ্কের বিমান ও ভ্রমণ বিষয়ক সিনিয়র ফেলো উইলিয়াম ম্যাকগির মতে, “এগুলো একটি জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যা বিমান সংস্থাগুলির উপর প্রভাব ফেলছে।
গ্রীষ্মকালে বিমান সংস্থাগুলির ব্যবসা তুলনামূলকভাবে দুর্বল হতে পারে, যদিও এই সময়েই তারা সবচেয়ে বেশি অর্থ উপার্জন করে থাকে।”
মুনাফা অর্জনের পরিবর্তে, বিমান সংস্থাগুলি এখন অর্থ সাশ্রয়ের জন্য বছরের বাকি সময়ের জন্য তাদের ফ্লাইট রুটে কাটছাঁট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমনকি তারা তাদের আয়ের পূর্বাভাসও কমিয়ে দিয়েছে।
নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ আরকা এয়ারলাইন ইনডেক্স অনুসারে, গত ২৯শে জানুয়ারী, রোনাল্ড রেগান ওয়াশিংটন ন্যাশনাল বিমানবন্দরে মারাত্মক দুর্ঘটনার পর থেকে বিমান সংস্থাগুলির শেয়ারের মূল্য ২০ শতাংশের বেশি হ্রাস পেয়েছে।
এ বছর এটিই ছিল প্রথম বড় ধরনের বিমান দুর্ঘটনা। এরপর টরন্টোতে একটি ডেল্টা রিজিওনাল জেটের দুর্ঘটনা এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিমানবন্দরে আকাশে ও মাটিতে একাধিকবার বিমানের মধ্যে সংঘর্ষের মতো ঘটনা ঘটেছে।
ওয়াশিংটনে দুর্ঘটনার পর ডেল্টা এয়ারলাইন্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এড বাস্টিয়ান জানান, টিকিট বিক্রি তাৎক্ষণিকভাবে কমে গেছে, কারণ যাত্রীরা এখন উড়োজাহাজে ভ্রমণ করতে ভয় পাচ্ছেন। মার্চ মাসে বিনিয়োগকারীদের এক সম্মেলনে তিনি বলেন, “এর কারণে ভোক্তাদের মধ্যে একটা ধাক্কা লেগেছে।
আমরা দেখেছি কর্পোরেট ভ্রমণ এবং বুকিংয়ে দ্রুত পতন হয়েছে। আকাশপথে ভ্রমণের ক্ষেত্রে ভোক্তাদের আস্থা কমে গেছে, কারণ নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।”
নিরাপত্তা বিষয়ক উদ্বেগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিউ ইয়র্কের লিবার্টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের রাডার এবং বিমানের সঙ্গে যোগাযোগের সমস্যা। এর ফলে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলেও, অনেক কন্ট্রোলার মানসিক আঘাতের কারণে ছুটি নিতে বাধ্য হয়েছেন।
জনবল কমে যাওয়ার কারণে এই বিমানবন্দরে হাজার হাজার ফ্লাইটের শিডিউলে বিলম্ব হয়েছে এবং কিছু ফ্লাইট বাতিলও করতে হয়েছে।
উইলিয়াম ম্যাকগি আরও বলেন, “আমি অনেক বন্ধু, সহকর্মী এবং পরিচিতদের বলতে শুনেছি যে তারা এখনই উড়তে চান না। এর কারণ দুর্ঘটনার ভয় নয়, বরং বিলম্ব এবং ফ্লাইট বাতিলের মতো বিষয়গুলো তারা এড়িয়ে যেতে চান।”
নিরাপত্তা এবং বিলম্বের আশঙ্কার পাশাপাশি, বৃহত্তর অর্থনীতির বিষয়েও যাত্রীদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। কনফারেন্স বোর্ডের আস্থা জরিপে দেখা গেছে, এপ্রিল মাসে আগামী ছয় মাসে ভ্রমণ করতে ইচ্ছুক আমেরিকানদের সংখ্যা জানুয়ারীর তুলনায় ১২.৫% কমে গেছে।
আন্তর্জাতিক ভ্রমণ, যা যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি বৃহত্তম বিমান সংস্থার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়ের উৎস, তা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এভিয়েশন অ্যানালিটিক্স ফার্ম সিরিয়ামের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে অনলাইন ট্রাভেল সাইটের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউরোপের জন্য বুকিং এক বছর আগের তুলনায় ৯.৮% কমেছে।
ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ফ্লাইট বুকিংয়ের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ১২% পর্যন্ত কমেছে।
এছাড়াও, বিমানে চড়ার জন্য ‘রিয়েল আইডি’র বাধ্যবাধকতাও অনেক ভ্রমণকারীকে বিমানবন্দরে যেতে নিরুৎসাহিত করতে পারে। কারণ, এই আইডি আপগ্রেড করতে কয়েক সপ্তাহ এমনকি মাসও লাগতে পারে।
টিএসএ-এর এক মুখপাত্রের মতে, প্রায় ৭% আমেরিকান ‘রিয়েল আইডি’ অথবা পাসপোর্ট বা সামরিক আইডি-র মতো বিকল্প শনাক্তকরণ প্রমাণ ছাড়াই টিএসএ চেকপয়েন্টগুলোতে আসছেন। তবে অতিরিক্ত স্ক্রিনিংয়ের পর তাদের অনেককে যেতে দেওয়া হচ্ছে।
অতীতেও বিমান সংস্থাগুলো এমন কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে আকাশপথে চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, যার জন্য ফেডারেল সহায়তা প্রয়োজন হয়েছিল।
৯/১১-এর সন্ত্রাসী হামলার পর দেউলিয়া হওয়া এবং একত্রীকরণের ঘটনা ঘটেছিল। জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণেও বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। তবে এবার গ্রীষ্মকালে যখন তারা স্বাভাবিক ব্যবসা আশা করেছিল, তখন তাদের জন্য সম্ভবত কঠিন পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন