মাছ কি ঘুমায়? বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাদেরও বিশ্রাম দরকার
সাগর আর নদীর গভীরে বাস করা প্রাণীদের জগৎ সবসময়ই আমাদের কৌতূহলের বিষয়। তাদের জীবনযাত্রা, আচরণ, এমনকি ঘুমের ধরণও আমাদের থেকে বেশ আলাদা।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একটি প্রতিবেদনে বিজ্ঞানীরা মাছের ঘুমের রহস্য উন্মোচন করেছেন। আসুন, সেই গবেষণার আলোকেই জানা যাক মাছের ঘুমের কিছু অজানা কথা।
সাধারণভাবে, দিনের আলোয় যারা প্রবাল প্রাচীরে ঘুরে বেড়ায়, রাতের আঁধারে তাদের দেখা পাওয়া যায় না। এর কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, দিনের আলো ফুরোলেই তারা বিশ্রাম নিতে যায়।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির নিউরোসায়েন্টিস্ট ফিলিপ মরাঁর মতে, “গবেষণায় দেখা গেছে, সকল প্রাণীকেই ঘুমের প্রয়োজন।”
তবে মাছের ঘুমের ধরন অন্যান্য প্রাণীর থেকে আলাদা। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালে বিজ্ঞানীরা জ্যাব্রা মাছের ওপর গবেষণা করেন।
তারা বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে মাছটির ঘুমের ধরন পর্যবেক্ষণ করেন। এই গবেষণায় দেখা যায়, জ্যাব্রা মাছের ঘুমের ধরণ মানুষের গভীর ঘুমের মতোই।
এমনকি তাদের মধ্যে র্যাপিড-আই মুভমেন্ট বা চোখের দ্রুত নাড়ার মতো বিষয়ও দেখা যায়।
মাছের প্রজাতি অনুযায়ী ঘুমের ধরনে ভিন্নতা দেখা যায়। কিছু মাছ স্তন্যপায়ী প্রাণীর মতো আচরণ করে, আবার কারো বিশ্রাম নেওয়ার পদ্ধতি আমাদের ধারণার চেয়ে আলাদা।
ফ্লোরিডা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সমুদ্র জীববিজ্ঞানী মাইকেল হেইথাউসের মতে, “মাছের মস্তিষ্কেরও বিশ্রাম প্রয়োজন, যা তাদের শরীর থেকে দূষিত পদার্থ দূর করতে সাহায্য করে।”
শार्क মাছ কি ঘুমায়?
অনেক সময় শোনা যায়, যদি কোনো হাঙর মাছ সাঁতার কাটা বন্ধ করে দেয়, তাহলে সে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যাবে। তবে, এই ধারণা সবসময় সঠিক নয়।
কিছু হাঙর সাঁতার না কাটলেও শ্বাস নিতে পারে।
অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবেদী জীববিজ্ঞানী ক্রেগ রাডফোর্ড ব্যাখ্যা করেন, মাছেরা দুটি উপায়ে শ্বাস নেয় – একটি হলো ‘র্যাম ভেন্টিলেশন’, যেখানে মাছ সাঁতার কাটার মাধ্যমে জলের ভেতর দিয়ে শ্বাস নেয়।
অন্যটি হলো ‘বুক্কাল পাম্পিং’, যেখানে চোয়ালের মাধ্যমে তারা জল গ্রহণ করে।
২০১৭ সালে ডুবুরিদের তোলা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, কিছু হোয়াইটটিপ রিফ শার্ক (Whitetip reef sharks) দলবদ্ধভাবে প্রায় স্থির হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে।
রাডফোর্ড জানান, “কার্পেট শার্ক সহ কিছু হাঙর তাদের চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নেয়, এবং সামান্য উদ্দীপনায় তারা জেগে ওঠে।”
গবেষকেরা আরও দেখেছেন, কিছু বাচ্চা সাদা হাঙর ধীরে ধীরে বৃত্তাকারে সাঁতরায় এবং সমুদ্রের নিচে তাদের চলার পথে বিশেষ চিহ্ন তৈরি করে, যা অনেকটা শস্যক্ষেতের মতো দেখায়।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, হয়তো এই সময়টাতে হাঙরগুলো এক ধরনের ‘অটো-পাইলট’ মোডে থাকে, যেখানে তারা সাঁতার কাটে এবং শ্বাস নেয়, কিন্তু তাদের মস্তিষ্ক বিশ্রাম নেয়।
সম্ভবত তারা ‘ইউনিহেমিস্ফেরিক স্লিপ’-এ যায়, অর্থাৎ তাদের মস্তিষ্কের অর্ধেক ঘুমায়।
ডলফিনও একই কাজ করে থাকে।
দিনের বেলা সক্রিয়, নাকি রাতের?
দিনের আলো ও রাতের আঁধারে মাছেরা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সক্রিয় থাকে। কিছু মাছ দিনের বেলায় বিচরণ করে, আবার কিছু মাছ রাতের অন্ধকারে শিকার করে।
অনেক রিফ শার্ক রাতে সক্রিয় থাকে।
সমুদ্রে বসবাসকারী কিছু মাছ, যেমন প্যারটফিশ, ঘুমের সময় তাদের শরীরকে শ্লেষ্মা দিয়ে ঢেকে নেয়।
এই শ্লেষ্মা তাদের শিকারী এবং পরজীবীর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে।
এছাড়াও, এই শ্লেষ্মায় অ্যান্টিবায়োটিকও থাকে, যা রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুদের প্রতিরোধ করে।
গভীর সমুদ্রের মাছেরাও বিশ্রাম নেয়।
সম্ভবত তাদের শরীরে নিজস্ব সার্কাডিয়ান রিদম (circadian rhythm) বা জৈবিক ঘড়ি বিদ্যমান, যা তাদের ঘুমের সময় নির্ধারণ করে।
সবশেষে, বিজ্ঞানীরা বলছেন, মাছেরা আমাদের থেকে খুব বেশি আলাদা নয়।
বরং, মাছই হলো পৃথিবীর প্রথম মেরুদণ্ডী প্রাণী। তাই, প্রশ্নটা হওয়া উচিত – “আমরা কি তাদের মতো ঘুমাই?”
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক