**বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে ফুসফুসের মারাত্মক ছত্রাক সংক্রমণের বিস্তার, ঝুঁকিতে বাংলাদেশ?**
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে মারাত্মক ‘অ্যাস্পারজিলোসিস’ নামক ফুসফুসের সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা বাড়ছে। এই ছত্রাক সংক্রমণ (fungal infection) প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ২৫ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়, এমনটাই ধারণা করা হচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশ্ব এখনো প্রস্তুত নয়। বিশেষ করে উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে অ্যাস্পারজিলাস নামক এক প্রকার ছত্রাকের প্রজাতি দ্রুত নতুন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে।
ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী কম্পিউটার মডেলিং এবং পূর্বাভাস ব্যবহার করে দেখেছেন, অ্যাস্পারজিলাস-এর কিছু প্রজাতি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, চীন এবং রাশিয়ার মতো বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তার লাভ করবে। এই ছত্রাকগুলি মূলত মাটি, আবর্জনা এবং পানিতে জন্মায়।
অ্যাস্পারজিলাস-এর কারণে সৃষ্ট রোগটি হলো ‘অ্যাস্পারজিলোসিস’, যা প্রধানত ফুসফুসে আক্রমণ করে এবং জীবনহানির কারণ হতে পারে। উদ্বেগের বিষয় হলো, এই রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধগুলোর কার্যকারিতা কমে আসছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যাদের ফুসফুসের সমস্যা রয়েছে, যেমন – অ্যাজমা, সিস্টিক ফাইব্রোসিস (cystic fibrosis) এবং সিওপিডি (COPD) রোগী অথবা যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, যেমন ক্যান্সার বা অঙ্গ প্রতিস্থাপন (organ transplant) হয়েছে এমন ব্যক্তিদের জন্য এই ছত্রাক সংক্রমণ খুবই মারাত্মক। সংক্রমিত ব্যক্তির শরীরে যদি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল থাকে, তাহলে ছত্রাক দ্রুত বাড়তে শুরু করে এবং শরীরের অভ্যন্তর থেকে ধীরে ধীরে অঙ্গহানি ঘটায়।
অ্যাস্পারজিলোসিস-এ আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে মৃত্যুর হার প্রায় ২০ থেকে ৪০ শতাংশ। রোগ নির্ণয় করাও বেশ কঠিন, কারণ এর প্রাথমিক লক্ষণগুলো অন্যান্য সাধারণ রোগের মতোই।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে *অ্যাস্পারজিলাস ফ্ল্যাভাস* নামক একটি প্রজাতি, যা উষ্ণ ও আর্দ্র অঞ্চলে বেশি দেখা যায়, তার বিস্তার ১৬ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। এই প্রজাতি উত্তর আমেরিকা, উত্তর চীন এবং রাশিয়াতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
এটি মানুষের মধ্যে গুরুতর সংক্রমণ ঘটায় এবং অনেক অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধের প্রতি প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি করতে পারে। এছাড়া, এটি বিভিন্ন খাদ্যশস্যকেও সংক্রমিত করে, যা খাদ্য নিরাপত্তা জন্য হুমকি স্বরূপ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জনস্বাস্থ্য এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল প্রতিরোধের ঝুঁকির কারণে ২০২২ সালে অ্যাস্পারজিলাস ফ্ল্যাভাসকে গুরুত্বপূর্ণ ছত্রাক রোগ সৃষ্টিকারীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।
অন্যদিকে, *অ্যাস্পারজিলাস ফিউমিগেটাস* নামক প্রজাতি, যা অপেক্ষাকৃত শীতল অঞ্চলে বেশি দেখা যায়, বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে উত্তর মেরুর দিকে বিস্তার লাভ করতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, ২১০০ সাল নাগাদ এর বিস্তার ৭৭.৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে, যা ইউরোপের প্রায় ৯০ লক্ষ মানুষকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলো, যেমন – বন্যা, খরা, এবং তাপপ্রবাহ, ছত্রাকের বিস্তারকে আরও বাড়িয়ে দেয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর ছত্রাক রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ারও প্রমাণ রয়েছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি বিষয়টি বিবেচনা করি, তাহলে দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের দেশ এমনিতেই মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। একদিকে বাড়ছে গড় তাপমাত্রা, অন্যদিকে ঘন ঘন বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো আছেই।
এমন পরিস্থিতিতে অ্যাস্পারজিলোসিসের বিস্তার ঘটলে তা দেশের স্বাস্থ্যখাতের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে। এছাড়া, *অ্যাস্পারজিলাস ফ্ল্যাভাস* খাদ্যশস্যে সংক্রমণ ঘটালে খাদ্য নিরাপত্তা আরও হুমকির মুখে পড়বে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, এই রোগের বিস্তার রোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, রোগ নির্ণয়ের উন্নত ব্যবস্থা এবং সময় মতো চিকিৎসার ব্যবস্থা করা জরুরি। একইসঙ্গে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়াটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তথ্য সূত্র: CNN