পোপ লিও চতুর্দশ, যিনি পূর্বে বিশপ রবার্ট প্রিভোস্ট নামে পরিচিত ছিলেন, তাঁর অতীতের কিছু কাজকর্মের জন্য বর্তমানে সমালোচনার শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে, তিনি কীভাবে যাজকদের দ্বারা সংঘটিত হওয়া যৌন নির্যাতনের অভিযোগগুলো পরিচালনা করেছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
তবে এই সময়ে, একটি শক্তিশালী ক্যাথলিক আন্দোলনের শিকার হওয়া ব্যক্তিরা তাঁর পক্ষ সমর্থন করছেন। এই আন্দোলনের নাম ছিল সোডালিটিয়াম ক্রিশ্চিয়ানে ভিটায়ে।
সোডালিটিয়াম ছিল একটি ক্যাথলিক সংগঠন, যা এর নেতাদের দ্বারা সদস্যদের প্রতি আধ্যাত্মিক, শারীরিক এবং যৌন নির্যাতনের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়। পোপ ফ্রান্সিস এই বছর আনুষ্ঠানিকভাবে এটি ভেঙে দেন।
নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, ২০১৮ সাল থেকে, যখন প্রিভোস্ট পেরুর বিশপ ছিলেন, তিনি তাঁদের কথা শুনেছেন। অনেকেই যখন তাঁদের অভিযোগকে গুরুত্ব দেননি, তখন প্রিভোস্ট তাঁদের কথা শোনেন এবং ভ্যাটিকানকে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে রাজি করান।
এমনকি ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতেও তিনি সাহায্য করেন। তাঁদের মতে, ২০২২ সালে পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের ব্যবস্থা করেছিলেন প্রিভোস্ট, যার ফলস্বরূপ ভ্যাটিকান তদন্ত শুরু করে এবং সংগঠনটি বিলুপ্ত হয়।
যুক্তি হিসাবে, একজন ভুক্তভোগী, জোসে রে দে ক্যাস্ট্রো, যিনি দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে সোডালিটিয়ামের নেতা লুইস ফার্নান্দো ফিগারির ব্যক্তিগত বাবুর্চির কাজ করতেন, তিনি বলেন, “তিনি আমার কথা শুনেছিলেন। একজন যাজকের এমনটা করা স্বাভাবিক, কিন্তু সোডালিটিয়ামের ক্ষেত্রে তা ছিল ব্যতিক্রম, কারণ এটি খুবই শক্তিশালী ছিল।”
সোডালিটিয়াম মূলত পেরুতে ১৯৭০-এর দশকে প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ঈশ্বরের সৈনিক সংগ্রহের উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছিল। এটি ছিল লাতিন আমেরিকায় বামপন্থী মুক্তি আন্দোলনের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ গঠিত হওয়া কয়েকটি রক্ষণশীল ক্যাথলিক গোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম।
একসময় এই গোষ্ঠীর প্রায় ১০০০ সক্রিয় সদস্য ছিল এবং দক্ষিণ আমেরিকা ও যুক্তরাষ্ট্রে এর আরও তিনটি শাখা ছিল। পেরুতে এর যথেষ্ট প্রভাব ছিল এবং ডেনভারে এর একটি মার্কিন ঘাঁটি ছিল।
২০০০ সাল থেকে, ফিগারির বিতর্কিত কার্যকলাপের কথা ধীরে ধীরে পেরুতে প্রকাশ হতে শুরু করে। প্রাক্তন সদস্যরা একটি পত্রিকায় তাঁর বিরুদ্ধে লেখালেখি শুরু করেন।
যদিও স্থানীয় চার্চ এবং হলি সি (Holy See) প্রথমে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, প্রাক্তন সদস্য পেদ্রো স্যালিনাস এবং সাংবাদিক পাওলা উগাজ তাঁদের ২০১৫ সালের “হাফ মঙ্কস, হাফ সোলজার্স” বইয়ে সোডালিটিয়ামের কার্যকলাপ প্রকাশ করেন।
২০১৭ সালে, গোষ্ঠীর নতুন নেতৃত্বের করা একটি প্রতিবেদনে জানা যায়, ফিগারি তাঁর সদস্যদের যৌন নির্যাতন করতেন। এই ঘটনায় অনেকে পালিয়ে যান এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুখ খোলেন।
কিন্তু তাঁরা পেরুর ক্যাথলিক কর্তৃপক্ষ এবং হলি সির কাছ থেকে নীরবতা ও প্রতিকূলতার সম্মুখীন হন।
কিন্তু প্রিভোস্ট এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন। ২০১৪ সালে ফ্রান্সিস প্রিভোস্টকে পেরুর চিকলায়োর বিশপ নিযুক্ত করেন এবং পরে তিনি পেরুর বিশপ কনফারেন্সের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।
তিনি নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের কথা শোনার জন্য গঠিত একটি কমিশনের প্রধান ছিলেন এবং ভুক্তভোগী ও সোডালিটিয়ামের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘সেতু’ হিসেবে কাজ করেছেন।
২০২১ সালে, ফিগারির প্রাক্তন বাবুর্চি রে দে ক্যাস্ট্রো প্রিভোস্টের কাছে যান। প্রিভোস্টের সহায়তায় সোডালিটিয়ামের সঙ্গে একটি গোপন সমঝোতা হয়।
অন্যদিকে, স্যালিনাস এবং উগাজ জানিয়েছেন, সোডালিটিয়াম যখন তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে আইনি পদক্ষেপ নেয়, তখন প্রিভোস্ট তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
২০১৮ সালে, পিয়ুরার আর্চবিশপ, জোসে এগারেন, স্যালিনাসের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করলে প্রিভোস্ট এবং পেরুর ভ্যাটিকান রাষ্ট্রদূত পেরুর বিশপ কনফারেন্সের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের সমর্থন করে একটি বিবৃতি তৈরি করেন।
উগাজ বলেন, “এই প্রথম কেউ সোডালিটিয়ামের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কিছু করল।”
সোডালিটিয়ামের সমালোচনা যখন উগাজ ও স্যালিনাসের বিরুদ্ধে আরও বাড়ে, তখন প্রিভোস্ট ২০২২ সালের ১০ নভেম্বর উগাজের সঙ্গে ভ্যাটিকানে পোপ ফ্রান্সিসের একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করেন। সেই বৈঠকে উগাজ তাঁর অনুসন্ধানের ফলাফল তুলে ধরেন এবং ফ্রান্সিসকে তাঁর শীর্ষ যৌন অপরাধ বিষয়ক তদন্তকারীদের পেরুতে পাঠাতে রাজি করান।
২০২৩ সালের তদন্তের ফলস্বরূপ ফ্রান্সিস বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেন, যার শুরু হয় এগারেনের পদত্যাগ দিয়ে, যা প্রিভোস্ট পরিচালনা করেন। এরপর ফিগারি, এগারেন এবং আরও নয় জনকে বহিষ্কার করা হয় এবং অবশেষে চলতি বছরের এপ্রিলে সোডালিটিয়ামকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।
সোডালিটিয়াম তাদের বিলুপ্তি মেনে নিয়েছে এবং তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘটিত ‘অপব্যবহার ও নির্যাতনের’ জন্য ক্ষমা চেয়েছে।
বর্তমানে, প্রিভোস্টের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠছে। স্যালিনাস সম্প্রতি পেরুর একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে একটি পডকাস্টের আয়োজন করেন, যেখানে তিনি প্রিভোস্টের অতীতের কিছু কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
স্যালিনাস অভিযোগ করেন যে সোডালিটিয়ামের সমর্থকরা প্রিভোস্টকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছে।
উদাহরণস্বরূপ, চিকলায়োর তিনজন বোনের করা একটি অভিযোগের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, যেখানে তাঁরা প্রিভোস্টের অধীনস্থ এক যাজকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন।
ডায়োসিস এবং ভ্যাটিকান জানিয়েছে, প্রিভোস্ট যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যার মধ্যে ছিল যাজককে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া, ভ্যাটিকানের যৌন অপরাধ বিষয়ক অফিসে প্রাথমিক তদন্ত পাঠানো এবং ক্ষতিগ্রস্তদের মানসিক সাহায্য প্রদান করা।
তথ্যসূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস