পেন্টাগনের ডিইআই নীতির ভুলে সামরিক বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি?

যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাদের বীরত্বের অনেক গল্প শোনা যায়, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীতে এখন ভিন্ন এক বিতর্ক চলছে—সামরিক বাহিনীতে ‘বৈচিত্র্য, সাম্য ও অন্তর্ভুক্তি’ (Diversity, Equity, and Inclusion – DEI) বিষয়ক কর্মসূচি বাতিল করার সিদ্ধান্ত। অনেকে মনে করছেন, এই পদক্ষেপ আমেরিকার সামরিক ইতিহাসে বড় ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটাবে।

কারণ, অতীতের অনেক সামরিক ব্যর্থতার পেছনে ছিল কর্তৃপক্ষের এই ধরনের সিদ্ধান্ত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার একটি ঘটনার কথা ধরা যাক। ১৯৪১ সালে পার্ল হারবারে জাপানি নৌবাহিনীর বোমা হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী চরম ক্ষতির শিকার হয়।

এই ঘটনার মূল কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, তৎকালীন সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে জাপানিদের সম্পর্কে ভুল ধারণা ছিল। শ্বেতাঙ্গ নেতৃত্বাধীন সামরিক বাহিনী ‘গোষ্ঠীগত চিন্তাভাবনা’ (groupthink)-র শিকার হয়েছিল, যেখানে ভিন্ন মতামতের কোনো স্থান ছিল না।

ফলে, জাপানের আক্রমণের পূর্বাভাস পাওয়া সত্ত্বেও, তারা সেটিকে গুরুত্ব দেয়নি।

সামরিক ইতিহাসে এমন ভুলের কারণ বিশ্লেষণ করতে মনোবিজ্ঞানীরা ‘গ্রুপথিংক’-এর ধারণা দেন। তাদের মতে, যখন কোনো দলের সদস্যরা একই ধরনের চিন্তা করেন এবং ভিন্নমতকে উৎসাহিত করা হয় না, তখন এই ধরনের ভুল সিদ্ধান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীতে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, এবং অঞ্চলের মানুষের মধ্যে একতা তৈরির চেষ্টা করা হয়। বিভিন্ন পটভূমি থেকে আসা মানুষ একসঙ্গে কাজ করে দেশের জন্য।

অনেক সময় দেখা যায়, যুদ্ধের কঠিন পরিস্থিতিতে এই একতা সৈন্যদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক তৈরি করে।

কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে কিছু নেতা মনে করছেন, সামরিক বাহিনীতে ‘বৈচিত্র্য’ দুর্বলতা তৈরি করছে। তারা চান, সৈন্যদের মধ্যে আগের ‘যোদ্ধা’ মনোভাব ফিরিয়ে আনা হোক।

তাদের মতে, “আমাদের বৈচিত্র্যই আমাদের শক্তি” – এই ধারণাটি সামরিক ইতিহাসের সবচেয়ে ভুল ধারণাগুলোর মধ্যে একটি।

তবে, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক সামরিক বাহিনী অনেক বেশি কার্যকর হয়।

ইরাক যুদ্ধের সময় এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। সেখানে দেখা যায়, যখন একজন নারী সেনা কর্মকর্তার পরামর্শ অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তখন আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে।

বর্তমানে, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে।

দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সক্রিয় সেনাসদস্যদের মধ্যে প্রায় ১৭.৭ শতাংশ নারী। এছাড়া, সংখ্যালঘুদের সংখ্যাও বাড়ছে, যা প্রায় ৩২ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে।

কিন্তু এই পরিবর্তনের বিরোধিতা করা হচ্ছে।

বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উদযাপন এবং সংখ্যালঘু ও নারীদের অধিকার বিষয়ক বিভিন্ন কর্মসূচি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি, সামরিক লাইব্রেরি থেকে জাতিগত ন্যায়বিচার, লিঙ্গ এবং এলজিবিটিকিউ+ বিষয়ক বই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের পদক্ষেপ সামরিক বাহিনীর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। কারণ, ভিন্ন মত ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়েই একটি শক্তিশালী দল তৈরি হয়।

সামরিক বাহিনীতে যদি বিভিন্ন ধরনের মানুষের অংশগ্রহণ না থাকে, তাহলে তারা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হতে পারে।

সামরিক বাহিনীতে ‘বৈচিত্র্য’ শুধু সংখ্যালঘুদের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, শ্বেতাঙ্গ পুরুষদেরও এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

বিভিন্ন জাতির মানুষের সঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে তারা পারস্পরিক সম্মান ও সহানুভূতির গুরুত্ব বুঝতে পারে, যা একটি বহুজাতিক সমাজে বসবাস করার জন্য অপরিহার্য।

সামরিক বাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এর একতা।

বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, এবং বর্ণের মানুষ একসঙ্গে কাজ করে দেশের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকে।

তাদের মধ্যে তৈরি হওয়া এই বন্ধন অনেক দৃঢ় হয়, যা বিবাহ বা অন্য কোনো সম্পর্কের চেয়েও গভীর হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর ‘বৈচিত্র্য, সাম্য ও অন্তর্ভুক্তি’ বিষয়ক কর্মসূচি বাতিল করার সিদ্ধান্ত একটি ভুল পদক্ষেপ হতে পারে।

অতীতে এমন সিদ্ধান্তের কারণে সামরিক বাহিনী অনেক ক্ষতির শিকার হয়েছে। তাই, এই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার আগে এর ফল সম্পর্কে ভালোভাবে চিন্তা করা উচিত।

তথ্যসূত্র: সিএনএন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *