লেবাননের পৌরসভা নির্বাচনে হিজবুল্লাহর শক্ত অবস্থান। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ লেবাননে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া পৌরসভা নির্বাচনে শিয়া অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে তাদের শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে হিজবুল্লাহ।
যদিও ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের সাম্প্রতিক সংঘাতের কারণে দলটির রাজনৈতিক এবং সামরিক শক্তিতে কিছুটা ভাটা পড়েছে, তবুও এই নির্বাচনে তাদের সমর্থন কমে নাই। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা এই নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করে এমনটাই ধারণা করা হচ্ছে।
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় বেশ কয়েকটি ধাপে। রাজধানী বৈরুতের উত্তরে অবস্থিত মাউন্ট লেবানন থেকে শুরু করে, এরপর দেশের উত্তরাঞ্চল, বৈরুত এবং পূর্বাঞ্চলীয় বেকা উপত্যকা হয়ে অবশেষে দক্ষিণাঞ্চলে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, হিজবুল্লাহ এবং তাদের প্রধান রাজনৈতিক মিত্র দল আমাল আন্দোলনের প্রতি শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষের সমর্থন এখনো অটুট রয়েছে। লেবাননের আমেরিকান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ইমাদ সালামি আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “হিজবুল্লাহ-আমাল জোট তাদের সমর্থন ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে এবং শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে দলটির প্রতি কোনো উল্লেখযোগ্য দুর্বলতা দেখা যায়নি।”
যদিও নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে পুরনো রাজনৈতিক দলগুলো, তবে কিছু এলাকায় সংস্কারপন্থী এবং সরকার বিরোধী প্রার্থীরাও ভালো ফল করেছেন। এমনকি হিজবুল্লাহর শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত দক্ষিণাঞ্চলেও তারা কিছু আসনে জয়লাভ করেছে।
লেবাননে সংস্কারপন্থীদের কোনো সুসংগঠিত জোট না থাকলেও, ২০১৯ সালের সরকার বিরোধী আন্দোলনের সময় পরিচিত হওয়া কিছু রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীকে স্থানীয়ভাবে ‘এ পরিবর্তনকামী’ বা ‘পরিবর্তন আনয়নকারী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অধ্যাপক সালামি আরও যোগ করেন, “কিছু এলাকায় বিকল্প প্রার্থীদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি, যা এই সম্প্রদায়ের মধ্যে ভিন্নমত প্রকাশের একটি সীমিত সুযোগ তৈরি করেছে।”
বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনের সফল আয়োজন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নাওয়াফ সালামের সংস্কারপন্থী সরকারের জন্য একটি ইতিবাচক দিক। উল্লেখ্য, নির্বাচনের তারিখ প্রথমে ২০২২ সালে নির্ধারিত ছিল, কিন্তু সংসদীয় নির্বাচন, অর্থ সংকট এবং ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধের কারণে তা তিনবার স্থগিত করা হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, নির্বাচনের ফল পুরনো রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষেই গেছে। কারণ নির্বাচনের তারিখ নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকায় প্রার্থীরা প্রচারণার জন্য পর্যাপ্ত সময় পাননি। এমনকি যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া লেবাননের পুনর্গঠন ও মেরামতের জন্য বিশ্ব ব্যাংক ১১ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছে।
ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে হিজবুল্লাহর রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে বেশ ক্ষতি হয়েছে। এমনকি হিজবুল্লাহর শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতাও নিহত হয়েছেন। যুদ্ধ লেবাননের ক্ষমতা কাঠামোতেও পরিবর্তন এনেছে, যার ফলে হিজবুল্লাহর প্রভাব কিছুটা কমেছে।
দক্ষিণ লেবাননের অনেক গ্রাম এখনো ইসরায়েলি হামলার শিকার এবং সেখানে বসবাস করাও নিরাপদ নয়। সেখানকার অনেক ভোটার নাবাতিয়া ও টাইর শহরে ভোট দিয়েছেন। উল্লেখ্য, ২০০০ সালে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের আগে এই এলাকাগুলো তাদের দখলে ছিল।
একটি পশ্চিমা কূটনৈতিক সূত্র আল জাজিরাকে জানিয়েছে, হিজবুল্লাহ তাদের অনেক সামরিক ঘাঁটি লেবাননের সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছে।
পৌর নির্বাচন সাধারণত জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সরাসরি প্রতিফলিত করে না। কারণ ভোটারদের আগ্রহ কম থাকে এবং স্থানীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ভিন্ন হয়। অনেক বিশ্লেষক নির্বাচনের ফলকে ‘গুরুত্বহীন’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং তাদের মতে, আগামী সংসদীয় নির্বাচন দেশের রাজনৈতিক গতিপথ আরও স্পষ্টভাবে তুলে ধরবে।
২০১৬ সালের নির্বাচনের তুলনায় এবার প্রায় সব এলাকাতেই ভোটারের সংখ্যা কমেছে। দক্ষিণ লেবাননে যেখানে ২০১৬ সালে ভোট পড়েছিল ৪৮ শতাংশ, সেখানে এবার ভোট পড়েছে ৩৭ শতাংশ।
বেকা উপত্যকায়ও একই চিত্র দেখা গেছে, যা যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং যেখানে হিজবুল্লাহর জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। উত্তরে ভোটার উপস্থিতি ২০১৬ সালের ৪৫ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৩৯ শতাংশ। রাজধানী বৈরুতে অবশ্য ভোটার উপস্থিতি সামান্য বেড়েছে, যা ২০১৬ সালের ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৫ সালে হয়েছে ২১ শতাংশ।
দক্ষিণ লেবাননের অনেক মানুষ এখনো ইসরায়েলি হামলার শিকার হচ্ছেন। সেখানে অনেকে হিজবুল্লাহর এই যুদ্ধে জড়ানো এবং ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘর্ষের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। তবে অনেকে এখনও দলটির প্রতি সমর্থন বজায় রেখেছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক কাশেম কাসির আল জাজিরাকে বলেন, “পৌর নির্বাচনে এটা স্পষ্ট যে হিজবুল্লাহ এবং আমাল আন্দোলন এখনো শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। পরিবর্তনের পক্ষের শক্তি দুর্বল এবং তাদের প্রভাব কমেছে। হিজবুল্লাহ জনগণের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক বজায় রেখেছে।”
যদিও সংস্কারপন্থী দলগুলো কিছু আসনে জয়লাভ করেছে, তবে প্রচারণার স্বল্পতা এবং পরিচিতি কম থাকার কারণে তারা সুবিধা করতে পারেনি।
বৈরুতে পরিবর্তনকামী শক্তি বড় ধাক্কা খেয়েছে। ২০১৬ সালে তারা প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, কিন্তু কোনো আসনে জয়লাভ করতে পারেনি। এবার তাদের ভোট ১০ শতাংশেরও কম ছিল।
আগামী বছর অনুষ্ঠিতব্য সংসদীয় নির্বাচনের দিকে এখন সবার দৃষ্টি। দলগুলো তাদের প্রার্থী এবং নির্বাচনী ইশতেহার তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা