মার্কিন স্বাস্থ্যখাতে আঘাত, বিকল্প স্বাস্থ্য পণ্য ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত শীর্ষ উপদেষ্টার!

স্বাস্থ্যখাতে সংস্কারের নামে বিতর্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে স্বার্থের সংঘাতের অভিযোগ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্যখাতে সংস্কারের নামে বিতর্ক উঠেছে। আলোচনায় রয়েছেন রবার্ট এফ. কেনেডি জুনিয়রের (Robert F. Kennedy Jr.) শীর্ষ সহযোগী, ক্যালী মিন্স (Calley Means)। তিনি একইসাথে একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর বিকল্প পণ্যের প্রচার করেন, যা সরাসরি স্বার্থের সংঘাতের জন্ম দিয়েছে।

ক্যালী মিন্স ‘মেক আমেরিকা হেলদি এগেইন’ (Make America Healthy Again) আন্দোলনের সাথে যুক্ত। এই আন্দোলনের মূল বক্তব্য হলো, মার্কিন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং এর পেছনে থাকা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। তিনি প্রায়শই দেশটির চিকিৎসক সংগঠন, সরকারি সংস্থা এবং বিজ্ঞানীদের কঠোর সমালোচনা করে থাকেন। মিন্সের মতে, তারা সবাই নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে ব্যস্ত।

কিন্তু মিন্সের নিজেরও স্বাস্থ্যখাতে আর্থিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তিনি ‘ট্রুমেড’ (Truemed) নামক একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। এই প্ল্যাটফর্ম খাদ্য সম্পূরক, ভেষজ প্রতিকার এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর পণ্য সরবরাহ করে। উদ্বেগের বিষয় হলো, ট্রুমেডের ওয়েবসাইটে কেনেডির ‘মাহা’ (MAHA) আন্দোলনের কিছু সমর্থকের পণ্যও দেখা যায়। এই আন্দোলন প্রেসক্রিপশন ওষুধ, ভ্যাকসিন এবং পরীক্ষিত চিকিৎসা পণ্যের উপকারিতা কমিয়ে দেখায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মিন্সের এই দ্বৈত ভূমিকা গুরুতর। কারণ, তিনি একদিকে যেমন সরকারি নীতি নির্ধারণে জড়িত, তেমনি স্বাস্থ্যখাতে নিজের ব্যবসার প্রসার ঘটাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে স্বচ্ছতার অভাব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, সরকারি পদে থাকার কারণে মিন্সকে তার আর্থিক বিষয়গুলো প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে হয় না।

এই প্রসঙ্গে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য গবেষক ড. রেশমা রামচন্দ্রন বলেন, “বিষয়টি ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছু নয়। একদিকে তিনি এমন একটি শিল্পের প্রতিনিধিত্ব করছেন, যেখানে অনিয়ন্ত্রিত পণ্যের প্রচার করা হয়। অন্যদিকে, সরকারি পদে থেকে নিজের আর্থিক সুবিধা লাভের চেষ্টা করছেন।”

মিন্স অবশ্য বলেছেন, তার সরকারি কাজের সাথে ট্রুমেডের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি খাদ্য কর্মসূচির সংস্কার এবং খাদ্য রংয়ের ব্যবহার কমানোর মতো বিষয়গুলোতে মনোযোগ দিচ্ছেন।

ট্রুমেড ব্যবহারকারীদের স্বাস্থ্য সঞ্চয় অ্যাকাউন্ট (HSA) থেকে অর্থ ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়, যা সাধারণত চিকিৎসা ব্যয়ের অন্তর্ভুক্ত নয়। এর মধ্যে রয়েছে ব্যায়ামের সরঞ্জাম, খাবার সরবরাহ পরিষেবা এবং হোমিওপ্যাথিক প্রতিকার। গত বছর, অভ্যন্তরীণ রাজস্ব পরিষেবা (IRS) এই বিষয়ে সতর্ক করে বলেছে, “কোম্পানিগুলো যেন পুষ্টি, স্বাস্থ্য এবং সাধারণ স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে চিকিৎসা খরচ হিসাবে ভুলভাবে উপস্থাপন না করে।”

ট্রুমেডের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী জাস্টিন মার্স (Justin Mares) জানিয়েছেন, তারা আইআরএস-এর নির্দেশিকা অনুসরণ করেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মিন্সের এই কার্যকলাপ শুধু নৈতিকতার প্রশ্নই তোলে না, বরং সরকারি কার্যক্রমের প্রতি মানুষের আস্থাকেও দুর্বল করে।

মিন্সের উত্থান ‘মাহা’ আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ স্ববিরোধিতা তুলে ধরে। এই আন্দোলন কর্পোরেট সংস্থা এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলোর প্রতি অনাস্থা তৈরি করতে উৎসাহিত করে। মিন্স নিজেও একসময় বড় ফার্মাসিউটিক্যালস এবং খাদ্য কর্পোরেশনগুলোর পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন।

মিন্সের কোনো চিকিৎসা বিষয়ক প্রশিক্ষণ নেই। তিনি হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের স্নাতক। স্বাস্থ্যখাতে সংস্কারের আগ্রহের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি জানান, ২০২১ সালে তার মায়ের অগ্ন্যাশয় ক্যান্সারে মৃত্যুর পর তিনি এই বিষয়ে আগ্রহী হন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা স্বাস্থ্যখাতের উদ্যোক্তাদের জন্য একটি সাধারণ কৌশল। প্রথমে একটি স্বাস্থ্য সমস্যা চিহ্নিত করা হয়, তারপর সেটি নির্ণয়ের জন্য একটি পরীক্ষা বাজারজাত করা হয় এবং সবশেষে রোগটি নিরাময়ের জন্য সম্পূরক বা অন্যান্য প্রতিকার বিক্রি করা হয়।

ট্রাম্প প্রশাসনের সময় স্বাস্থ্যখাতে HSA-এর সম্প্রসারণের প্রস্তাব করা হয়েছিল। এর ফলে শরীরচর্চা এবং অন্যান্য ফিটনেস সম্পর্কিত খরচও করমুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তবে, সমালোচকদের মতে, এই ধরনের পদক্ষেপ মূলত ধনী ব্যক্তিদের সুবিধা করে দেবে। কারণ, তাদের HSA-তে অর্থ জমা করার বেশি সুযোগ থাকে।

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, HSA-এর এই ধরনের বিস্তার ঘটলে সরকারের সীমিত সম্পদ আরও কমে যাবে এবং স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ আরও সংকুচিত হবে।

(আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদন অবলম্বনে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *