দ্বীপরাষ্ট্র জামাইকার জলাভূমি আর ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে এক সময়ের প্রতাপশালী প্রাণী কুমির আজ বিলুপ্তির পথে। চোরা শিকার, আবাসস্থল ধ্বংস আর মানুষের ভীতি—এসব কারণে মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন এখানকার কুমিরেরা। তবে এই বিপদ থেকে তাদের বাঁচাতে জীবন বাজি রেখে লড়াই করছেন লরেন্স হেনরিকুইস।
পেশাগত জীবনে যিনি ‘কুমির রক্ষক’ নামেই পরিচিত।
জামাইকার দক্ষিণে সেন্ট থমাস থেকে ওয়েস্টমোরল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত উপকূলীয় অঞ্চলে মূলত এই কুমিরদের দেখা যায়। একসময় দ্বীপের মানুষের কাছে এরা ছিল শ্রদ্ধার পাত্র, আবার কারো কাছে ভয়ের কারণ।
কিন্তু বর্তমানে এদের সংখ্যা এতটাই কমে গেছে যে, টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে। অবৈধ শিকার, আবাসস্থলের অভাব এবং প্লাস্টিক দূষণ—এগুলো তাদের প্রধান শত্রু। এছাড়া স্থানীয়দের মধ্যে কুমির ভীতিও এর জন্য দায়ী।
এই পরিস্থিতিতে লরেন্স হেনরিকুইস নামের এক ব্যক্তি কুমিরদের রক্ষার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। গত চার দশক ধরে তিনি এদের সংরক্ষণে কাজ করছেন।
তিনি ‘হল্যান্ড বে কুমির অভয়ারণ্য’ পরিচালনা করেন। এটি দ্বীপের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত একটি স্থানীয় সংরক্ষণ প্রকল্প।
এখানে তিনি অসুস্থ কুমিরদের সুস্থ করে তোলেন, তাদের প্রজনন ঘটান এবং বন্য পরিবেশে ফিরিয়ে দেন।
হেনরিকুইস বলেন, “জামাইকাতে কুমিরদের নিয়ে মানুষের মধ্যে ভয় কাজ করে। অনেকে তাদের সহ্য করতে পারে না।
কারো বাড়ির উঠোনে যদি একটি কুমিরও দেখা যায়, তবে অনেকেই মাংসের জন্য বা ভয় থেকে সেটিকে মেরে ফেলে।”
যদিও কুমিরকে আক্রমণাত্মক এবং বিপদজনক হিসেবে দেখা হয়, তবে তাদের দ্বারা আক্রমণের ঘটনা খুবই কম।
যদিও নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন, তবে গত দশ বছরে জামাইকাতে কুমির আক্রমণের ১১টি ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ২০১৮ সালে একজন মারা যায়।
এ কারণেই হেনরিকুইস কুমির সম্পর্কে মানুষের ধারণা বদলাতে চান।
তিনি চান, মানুষ বুঝুক যে তারা যতটা ভয়ঙ্কর, আসলে ততটা নয়।
ষাটের দশকে জামাইকার রাজধানী কিংস্টনে বেড়ে ওঠা হেনরিকুইসের ছোটবেলা থেকেই পোকামাকড়ের প্রতি আকর্ষণ ছিল।
আর কুমির সবসময় তার মনোযোগ কেড়েছে।
হেনরিকুইস বলেন, “আগে এখানে অনেক বেশি কুমির ছিল, তাদের জন্য পর্যাপ্ত আবাসস্থলও ছিল।
আমার নিজের ঘরেও সবসময় কয়েকটা করে কুমিরছানা থাকত।”
এই আকর্ষণই একসময় পেশায় পরিণত হয়।
পড়াশোনা শেষে বৈদেশিক অভিজ্ঞতা নিয়ে ১৯৮০ সালে তিনি যখন জামাইকায় ফিরে আসেন, তখন দেখেন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী কুমিরকে বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে ঘোষণা করা হলেও, বাস্তবে তাদের সংরক্ষণে তেমন কোনো কাজ হচ্ছে না।
তিনি জানান, “আইন ছিল, কিন্তু কেউ কিছু করছিল না।
পরিবেশ বিষয়ক সংস্থাগুলোরও যথেষ্ট জনবল ছিল না।
সরীসৃপ সম্পর্কে যাদের জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা আছে, তেমন মানুষও ছিল না।”
এরপর হেনরিকুইস সরকারের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ শুরু করেন।
কুমির উদ্ধার ও পুনর্বাসনের পাশাপাশি তিনি সাইট্রাস শিল্পেও কাজ করতেন।
প্রায় ২০ বছর ধরে তিনি এভাবেই কাজ চালিয়ে যান।
পরে যুক্তরাজ্যে কিছুদিন থাকার পর ২০১০ সালে তিনি আবার জামাইকায় ফিরে আসেন এবং ‘হল্যান্ড বে কুমির অভয়ারণ্য’ প্রতিষ্ঠা করেন।
এই অভয়ারণ্যে বর্তমানে ২৭টি পূর্ণবয়স্ক কুমির এবং ১৮টি কুমিরছানা রয়েছে।
এখানে জন্ম নেওয়া কুমিরছানাগুলোকে সাধারণত তিন বছর পর প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এছাড়া, আহত বা মানুষের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত কুমিরদেরও এখানে পুনর্বাসন করা হয়।
হেনরিকুইসের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে প্রায় ৯০টি কুমিরকে সফলভাবে প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
অভয়ারণ্যের একটি কুমির হলো জেনা।
তাকে একবার আবর্জনায় ভরা একটি জায়গায় ডিম পাহারা দিতে দেখা গিয়েছিল।
দূষণের কারণে তার চামড়া পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছিল এবং দাঁতগুলো ধূসর হয়ে গিয়েছিল।
গ্যাটরল্যান্ড গ্লোবালের আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি সাভানা বোয়ান জানান, এখানে আসার পর জেনার চামড়া আগের মতো হয়েছে এবং দাঁত সাদা হয়েছে।
তার বাচ্চাদেরও এখানে বড় করা হয়েছে এবং নিরাপদ স্থানে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, যা বন্য পরিবেশে কুমিরের সংখ্যা বাড়াতে সাহায্য করছে।
বোয়ান বলেন, “লরেন্স সীমিত সম্পদ দিয়ে অসাধারণ কাজ করছেন।”
তবে কুমিরদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হলো চোরা শিকার।
দেশটির জাতীয় পরিবেশ ও পরিকল্পনা সংস্থার (এনইপিএ) কর্মকর্তারা জানান, মাংসের চাহিদা এবং কুসংস্কারের কারণে এখানে কুমির শিকারের প্রবণতা বাড়ছে।
এনইপিএ-র পরিবেশ কর্মকর্তা লেইটন মামদিন বলেন, “অবৈধ শিকার একটি বড় সমস্যা।
আমরা নিয়মিত নজরদারি ও টহল দেওয়ার মাধ্যমে এটি প্রতিরোধের চেষ্টা করি।
এক্ষেত্রে আমরা জামাইকা পুলিশ এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীর সঙ্গে কাজ করি।”
বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জামাইকাতে কুমিরের মাংস ও ডিমের একটি কালোবাজারি চক্র সক্রিয় রয়েছে।
এখানে এক পাউন্ড (৪৫০ গ্রাম) মাংসের দাম প্রায় ৫০০০ জামাইকান ডলার (বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৫,০০০ টাকা), যা মুরগির মাংসের দামের চেয়ে ১০ গুণেরও বেশি।
এমনকি, কোনো কোনো এলাকার মানুষের মধ্যে ধারণা রয়েছে যে কুমিরের মাংস খেলে যৌন ক্ষমতা বাড়ে।
এছাড়া, কুমিরের লেজ দিয়ে বিভিন্ন ভেষজ ওষুধ তৈরিরও গুজব শোনা যায়।
এনইপিএ-র আরেক পরিবেশ কর্মকর্তা দামানি ক্যাল্ডারের মতে, কুমিরের লেজ কেটে ফেলার ঘটনাও প্রায়ই দেখা যায়।
“কুমিরের লেজ ব্যবহারের গুজব রয়েছে… হয় যৌনক্ষমতা বাড়ানোর জন্য, না হয় উর্বরতা বা দীর্ঘ জীবনের জন্য,” তিনি জানান।
অন্যান্য ঘটনার মধ্যে, কুমিরকে বাড়ির পুকুরে পোষা বা টিকটক ভিডিওর শুটিংয়ে ব্যবহারের মতো ঘটনাও ঘটেছে।
ক্যাল্ডারের মতে, একবার একটি ভাঙা ফ্রিজের ভেতর একটি জীবিত কুমিরছানা পাওয়া গিয়েছিল, যা সম্ভবত ওবিয়া নামক একটি স্থানীয় ধর্মীয় রীতির অংশ ছিল।
সোশ্যাল মিডিয়াতে এমন ভিডিও দেখা গেলে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
তবে, অপরাধীদের ঘটনাস্থলে হাতেনাতে ধরতে পারলেই কেবল তাদের শাস্তি দেওয়া যায়।
কুমির হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হলে ১ লক্ষ ডলার জরিমানা অথবা এক বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।
হেনরিকুইস বলেন, “পুলিশ কঠোরভাবে জড়িত এবং তারা শাস্তির পরিমাণ বাড়ানোর চেষ্টা করছে।
তবে, সমস্যা হলো অপরাধীকে ধরা এবং আদালতে তা প্রমাণ করা—এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া।”
আবাসস্থল ধ্বংসও একটি বড় সমস্যা।
বন বিভাগ জানিয়েছে, পর্যটন ও আবাসিক উন্নয়নের জন্য জামাইকার ম্যানগ্রোভ ও জলাভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে।
এর ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে, কারণ ম্যানগ্রোভ ঝড়ের সময় ঢেউয়ের শক্তি কমায় এবং বন্যারোধ করে।
একইসঙ্গে, কুমিরের মতো বিভিন্ন প্রজাতির আবাসস্থলও ধ্বংস হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে কুমিরগুলো মানুষের কাছাকাছি আসতে বাধ্য হচ্ছে।
হেনরিকুইস বলেন, “এরা সবসময় যেখানে ছিল, সেখানেই আছে।
কিন্তু এখন সেই জায়গাগুলো শহর বা রাস্তা হয়ে গেছে… আমরা তাদের আবাস কেড়ে নিয়েছি।”
হেনরিকুইসের মতে, কুমির কোনো হুমকি নয়, বরং তারা এই দ্বীপের বাস্তুতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
জামাইকার রাষ্ট্রীয় প্রতীকেও কুমিরের ছবি রয়েছে।
তিনি বলেন, “এরা হলো বাস্তুতন্ত্রের প্রকৌশলী।
তারা খাল খনন করে, মাছের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে এবং জলাভূমিকে সুস্থ রাখে।”
তবে, চোরা শিকার ও আবাসস্থলের অভাবে উপকূলীয় অঞ্চলে এখন বেশি সংখ্যক বড় পুরুষ কুমির নেই।
হেনরিকুইস সতর্ক করে বলেন, “অধিকাংশ কুমির এখন ছোট আকারের।
এটি একটি গুরুতর পরিবর্তন।”
তিনি আরও যোগ করেন, “জামাইকাতে যা ঘটছে, তা বিশ্বজুড়ে একটি সাধারণ চিত্র—জলাভূমির প্রজাতিগুলো বিলুপ্ত হচ্ছে এবং তাদের সঙ্গে পুরো বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”
এই সংকট মোকাবিলায় স্থানীয়দের সচেতন করতে হেনরিকুইস এবং এনইপিএ বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, বিশেষ করে কুমিরের আবাসস্থলের কাছাকাছি বসবাসকারী মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো হচ্ছে।
মামদিন বলেন, “আমরা স্কুলগুলোতে গিয়েছি।
শিশুদের সচেতন করতে পারলে, তাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার সম্ভাবনা বেশি থাকে।”
যখন একটি স্কুলের কাছে পুকুরে কুমির দেখা গিয়েছিল, তখন সেখানকার শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল।
এরপর এনইপিএ স্থানীয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করে।
মামদিন বলেন, “আমরা তাদের বুঝিয়েছি যে কুমির আপনাকে আক্রমণ করার চেয়ে ভয় পেয়ে পালিয়ে যেতে চাইবে।
রাতের বেলা জলের কাছে গেলে হাতে একটি লাঠি নিন।
কুমিরকে স্পর্শ করলে, সে চলে যাবে।”
হেনরিকুইস যোগ করেন, “মানুষ এখন বুঝতে শুরু করেছে যে এই প্রাণীদেরও একটা জায়গা আছে… তারা কোনো উপদ্রব নয়, বরং তারা টিকে থাকার যোদ্ধা।”
বর্তমানে জামাইকাতে কুমির সংরক্ষণে খুব বেশি উদ্যোগ নেই।
হেনরিকুইস আশঙ্কা করেন, উপযুক্ত সহায়তা না পেলে আগামী কয়েক দশকে জামাইকার কুমিরেরা হয়তো বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, “আমরা তাদের হারাতে পারি না।
তারা আমাদের চেয়েও আগে এখানে ছিল।
তারা এই ভূমির অংশ।”
তথ্য সূত্র: CNN