পশ্চিমের দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বৈদেশিক সাহায্য কমাচ্ছে, যা ২০২৬ সাল নাগাদ আরও বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, এবং কানাডার মতো দেশগুলো এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কাটছাঁট করছে।
সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট (CGD) নামক একটি গবেষণা সংস্থার নতুন বিশ্লেষণ থেকে এই তথ্য জানা গেছে।
এই সাহায্য হ্রাসের ফলে অনেক দরিদ্র দেশ “গুরুত্বপূর্ণ ক্ষতির” শিকার হবে। ওয়াশিংটন ডিসি ভিত্তিক গবেষণা সংস্থাটি জানিয়েছে, এর ফলে ইথিওপিয়া সবচেয়ে বেশি সাহায্য হারাবে।
এছাড়াও জর্ডান, আফগানিস্তান ও কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের মতো দেশগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ক্ষুদ্র দেশগুলোর মধ্যে লেসোথো, মাইক্রোনেশিয়া এবং এসওয়াতিনি তাদের সাহায্যের প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হারাতে পারে।
CGD-এর বিশ্লেষণে দেখা গেছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দারিদ্র্য বিমোচন এবং রূপান্তরের যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা, তাতে এই কাটছাঁটগুলো বাধা সৃষ্টি করবে।
সংস্থার গবেষকদের একজন, লি ক্রফোর্ড, জানিয়েছেন, “বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র এবং দুর্বল দেশগুলো এর শিকার হবে।”
বিশ্লেষণে দ্বিপাক্ষিক সাহায্যের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। দ্বিপাক্ষিক সাহায্য হলো, জাতিসংঘের সংস্থা বা বিশ্ব ব্যাংকের মতো বহুপাক্ষিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে না গিয়ে সরাসরি কোনো দেশকে দেওয়া অর্থ।
২০২৫ ও ২০২৬ সালের জন্য এই সাহায্যের হিসাব করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কাটছাঁট করতে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, দুই বছর আগের তুলনায় দেশটি ৫৬ শতাংশ সাহায্য কম দেবে।
ট্রাম্প প্রশাসনের সময়ে ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (USAID)-এর বাজেট কমানোর সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক সাহায্য বাজেটকে দুর্বল করে দিয়েছে। অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোও এই পথে হাঁটছে।
ক্রফোর্ড বলেন, “আগামী কয়েক বছরে সাহায্য হ্রাসের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ভূমিকা থাকবে, তবে অন্যান্য দেশগুলোও পরিস্থিতি আরও খারাপ করছে।”
যুক্তরাজ্য তাদের সাহায্য ব্যয়ের পরিমাণ ২০২৩ সালের তুলনায় প্রায় ৩৯ শতাংশ কম করতে পারে। জার্মানি প্রায় ২৭ শতাংশ, কানাডা ২৫ শতাংশ এবং ফ্রান্স তাদের আন্তর্জাতিক সাহায্য বাজেট ১৯ শতাংশ কমাতে পারে।
সাহায্য কমানোর আসল পরিমাণ এখনো পরিষ্কার নয়, কারণ ট্রাম্প প্রশাসনের প্রস্তাবিত বাজেট এবং অন্যান্য সরকারি প্রস্তাব এখনো আইনসভাগুলোতে বিবেচনাধীন।
তবে কিছু ক্ষেত্রে যে অর্থ কাটছাঁট হবে, তা নিশ্চিত।
ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেইর স্টারমার ঘোষণা করেন যে, তার সরকার ২০২৩ সালে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়াবে এবং ২০২৭ সাল নাগাদ মোট জাতীয় আয়ের ০.৩ শতাংশে সাহায্য বাজেট নামিয়ে আনবে, যা ১৯৯৯ সালের পর সর্বনিম্ন।
অনেক সংস্থা ও সাহায্যকর্মী ইউরোপীয় সরকারগুলোর সাহায্য বাজেট ও প্রতিরক্ষা ব্যয়ের মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
অক্সফাম জিবি-র প্রধান হালিমা বেগম বলেন, “সাহায্যের পরিমাণ কমানো একটি ভুল সিদ্ধান্ত এবং এটি বিভেদ আরও বাড়াবে। দরিদ্র মানুষের প্রতি এটি বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া কিছু নয়।
দারিদ্র্য দূরীকরণে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং জাতীয় নিরাপত্তা—এই দুটির মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করাটা একটা ভুল ধারণা।”
ক্রফোর্ড আরও যোগ করেন যে, দ্বিপাক্ষিক সাহায্য সরকারের বাজেটের একটি “ছোট অংশ”।
তিনি মনে করেন, প্রতিরক্ষা বা নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ অন্য কোথাও থেকে পাওয়া যেতে পারে। “এটা একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত,” তিনি উল্লেখ করেন।
CGD তাদের বিশ্লেষণে লিখেছে, “একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কিছু দেশ তাদের প্রধান দাতাদের কারণে অনেক বেশি পরিমাণ অফিশিয়াল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিসটেন্স (ODA) হারাতে পারে, যেখানে অন্যরা সামান্যই হারাবে।”
অর্থাৎ, সাহায্য প্রাপক দেশের প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে এই ক্ষতির কোনো মিল নেই।
উদাহরণস্বরূপ, ইয়েমেন তাদের দ্বিপাক্ষিক সাহায্য ২০১৯ সালের তুলনায় ১৯ শতাংশ হারাতে পারে, যেখানে তাদের প্রতিবেশী সোমালিয়া প্রায় ৩৯ শতাংশ সাহায্য হারাতে পারে।
জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিষয়ক দপ্তর (OCHA) সতর্ক করে জানিয়েছে, বহুপাক্ষিক সাহায্য কমানোর ফলে গুরুতর মানবিক সংকটের মোকাবিলায় সমস্যা হবে।
এপ্রিল মাস পর্যন্ত জাতিসংঘের জরুরি ত্রাণ কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের মাত্র ১১.৯ শতাংশ পাওয়া গেছে।
OCHA-র অংশীদারিত্ব ও সম্পদ সংগ্রহ বিষয়ক প্রধান আঞ্জা নিটজশ বলেন, “জাতিসংঘ প্রতি বছর যুদ্ধ ও দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এক কোটির বেশি মানুষকে সহায়তা করে।
তবে এটা পরিষ্কার যে, আমরা ২০২৫ সালে আগের বছরগুলোর মতো পর্যাপ্ত তহবিল পাব না।” তিনি আরও বলেন, “সুদান, ইয়েমেন, ইউক্রেন, মিয়ানমার ও আফগানিস্তানের মতো জায়গাগুলোতে অসহায় পরিবারগুলো খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, স্বাস্থ্যসেবা, আশ্রয় ও নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।”
ক্ষতি কমানোর উপায় হিসেবে CGD পশ্চিমা দেশগুলোকে দরিদ্রতম দেশগুলোতে সাহায্য পুনর্বণ্টন করার আহ্বান জানিয়েছে, যাতে “সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যাদের, তাদের কাছে সম্পদ পৌঁছানো যায়।”
পাশাপাশি, সংস্থাটি জানিয়েছে, পশ্চিমা দেশগুলোকে তাদের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে, বিশেষ করে যখন তারা সাহায্য দেওয়া বন্ধ করে দিচ্ছে।
কিছু দেশে সাহায্যদাতা বদল হওয়ার কারণে “সাহায্যের ধরন ও পদ্ধতিতে বড় পরিবর্তন আসতে পারে,” বলে CGD জানিয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, পর্তুগাল সম্ভবত অ্যাঙ্গোলাকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যকে ছাড়িয়ে যাবে। এছাড়া, জাপান মিশরে ফ্রান্সকে ছাড়িয়ে যেতে পারে।
বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, “নতুন প্রধান সাহায্যদাতা হয়তো আগের প্রোগ্রামগুলো চালিয়ে যাবে না অথবা নতুন প্রোগ্রাম শুরু করতে সময় নেবে।”
সাহায্যের একটি বড় অংশ বহুপাক্ষিক সংস্থাকে দিলে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়বে এবং সাহায্য কার্যক্রমের দ্বৈততা কমানো যেতে পারে।
ক্রফোর্ড বলেন, “সমন্বয় একটি চলমান চ্যালেঞ্জ। বিশ্ব ব্যাংকের মতো বড় বহুপাক্ষিক তহবিলে অর্থায়ন করা এর সবচেয়ে সহজ উপায়।”
তথ্য সূত্র: সিএনএন