আতঙ্কে দেশ! ট্রাম্পের আগ্রাসনে কি ভাঙবে সব?

যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিতর্কিত নীতিমালার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ক্রমশ বাড়ছে, যা তার দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্টের পদকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে পারে।

গণহারে অভিবাসী বিতাড়নের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে রাস্তায় নামছেন সাধারণ মানুষ। এই পরিস্থিতিতে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান উভয় দলের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও নতুন করে প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

হোয়াইট হাউস মনে করছে, তারা এই পরিস্থিতির সম্পূর্ণ সুবিধা নিতে পারবে।

তবে ট্রাম্পের আগ্রাসী পদক্ষেপগুলো তার দ্বিতীয় মেয়াদের দুটি প্রধান দিককে তুলে ধরে – এক, ক্ষমতা প্রদর্শনের আকাঙ্ক্ষা এবং দুই, আরও বেশি ক্ষমতা কুক্ষিগত করা।

ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গ্যাভিন নিউসাম অন্তত এই ইস্যুতে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন, যদিও অনেকের মতে তিনি সম্ভবত ২০২৮ সালের নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছেন।

ট্রাম্প প্রশাসনের এই কঠোর পদক্ষেপের ফলে ডেমোক্রেটরা আবারও দুর্বল প্রতিপন্ন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে।

তাদের কাছে এখনো পর্যন্ত ২০২৩ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ ব্যাখ্যার উপযুক্ত কোনো উপায় নেই।

দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় তারা হিমশিম খাচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে উভয় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের জন্য এখন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসাব-নিকাশ এবং দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এসেছে।

একদিকে ডেমোক্র্যাটদের রাজনৈতিক ভিত্তি রয়েছে, যারা প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত।

তবে তাদের আশঙ্কা হলো, দলের বামপন্থী অংশের চরম প্রতিক্রিয়া তাদের থেকে সেই ভোটারদের দূরে সরিয়ে দিতে পারে, যারা পূর্বে তাদের সমর্থন জুগিয়েছিল।

হোয়াইট হাউস হয়তো মনে করে, এই ধরনের সংঘাত তাদের জন্য রাজনৈতিক সুবিধা বয়ে আনবে এবং ডেমোক্র্যাটদের কোণঠাসা করতে পারবে।

কিন্তু ট্রাম্প এমন একটি উত্তেজনা তৈরি করছেন যা হয়তো তার নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হবে।

প্রতিবাদকারীদের কাছাকাছি সেনা মোতায়েন করার মাধ্যমে তিনি এমন একটি পরিস্থিতির জন্ম দিচ্ছেন, যেখানে সংঘাত অনিবার্য এবং তা অনেক ক্ষেত্রে ট্র্যাজেডিতে রূপ নিতে পারে।

এমনটা হলে, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত লাভের জন্য মানুষের জীবন ঝুঁকিতে ফেলার অভিযোগ আরও জোরালো হবে।

হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে এই সংকট মোকাবিলায় কঠোর এবং নির্দয় একটি অবস্থান নেওয়া হয়েছে।

হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট এক বিবৃতিতে বলেন, “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরোধিতার কারণে ডেমোক্র্যাটদের এখন তাদের সম্প্রদায়ের অবৈধ অভিবাসী অপরাধী, সহিংস বিক্ষোভকারী এবং লুটেরাদের পক্ষ নিতে হচ্ছে, যারা কেবল তাদের কাজ করছেন এমন আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের প্রতিপক্ষ।”

এই পদক্ষেপের মূল লক্ষ্য হলো বিতাড়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত মানুষগুলোকে ‘অমানবিক’ হিসেবে চিত্রিত করা।

অবৈধ অভিবাসীদের জীবন প্রায়শই ছিন্নভিন্ন পরিবার এবং নিপীড়ন বা দারিদ্র্য থেকে পালিয়ে আসা অসহায় মানুষের গল্প।

লেভিট এমন একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছেন যে, যারা বিতাড়নের শিকার হচ্ছেন, তারা সবাই “অবৈধ অভিবাসী খুনি, ধর্ষক ও শিশুপাচারকারী”।

রিপাবলিকানরাও এমন একটি পুরনো কৌশল অবলম্বন করছে যা ট্রাম্পকে দুবার ক্ষমতায় এনেছিল – ডেমোক্র্যাটরা পুলিশকে ঘৃণা করে, এমন একটা ধারণা তৈরি করা।

লেভিট বলেন, “এগুলো কেবল আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের প্রতি আক্রমণ নয়, বরং আমেরিকান সংস্কৃতি এবং সমাজের প্রতিও আঘাত।

বিক্ষোভকারীরা আমেরিকান পতাকা পুড়িয়েছে, ‘আইসকে ধ্বংস করো’ বলে শ্লোগান দিয়েছে এবং বিভিন্ন ভবনে সরকার বিরোধী শ্লোগান লিখেছে।”

এই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করার মূল উদ্দেশ্য হলো, ট্রাম্পের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিষয়ক নীতির বিরুদ্ধে ওঠা সাংবিধানিক সংকটকে ধামাচাপা দেওয়া।

ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সামরিক বাহিনীকে ব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন।

লেভিট আরও বলেন, “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কখনোই আমেরিকায় বিশৃঙ্খলা rule of mob-কে (জনতার শাসন) সমর্থন করবেন না।

সরকারের সবচেয়ে মৌলিক দায়িত্ব হলো আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং এই প্রশাসন সেই পবিত্র দায়িত্বকে গ্রহণ করে।

এ কারণেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ন্যাশনাল গার্ড এবং মেরিনদেরকে লস অ্যাঞ্জেলেসে মোতায়েন করেছেন, যাতে বিশৃঙ্খলা দূর করা যায় এবং আইন-শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করা যায়।

আমরা বিক্ষোভকারীদের সহিংসতা বন্ধ করব এবং অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা হবে।

অবৈধ অভিবাসীদের গ্রেফতার করার জন্য ট্রাম্প প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত থাকবে।”

প্রশাসনের কিছু বক্তব্য সম্ভবত বিতাড়ন প্রক্রিয়াকে আরও গতি দেওয়ার জন্য এবং সামরিক বাহিনীকে এই কাজে যুক্ত করার একটি চেষ্টা।

ট্রাম্প যদি কঠোর পদক্ষেপ না নেন, তবে বিতাড়ন বন্ধ হয়ে যাবে, আমেরিকানরা অনিরাপদ হবে এবং একটি বিদেশি ‘আক্রমণ’ সফল হবে, এমন একটা ধারণা তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

আর্কানসাসের সিনেটর টম কটন ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে এক নিবন্ধে লেখেন, “বিক্ষোভ বন্ধ করতে ব্যাপক শক্তি প্রদর্শনের জন্য সৈন্য পাঠানো উচিত।”

তিনি আরও লেখেন, “বামপন্থীদের হুমকি স্পষ্ট: অভিবাসন আইন কার্যকর করবেন না।

যদি করেন, তাহলে বামপন্থী রাস্তার মিলিশিয়ারা শহরগুলোতে আগুন দেবে এবং ডেমোক্রেট রাজনীতিবিদরা বিক্ষোভকারীদের সমর্থন করবেন।

প্রেসিডেন্ট এই হুমকি প্রত্যাখ্যান করে অভিবাসন আইন কার্যকর করতে এবং নাগরিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সম্পূর্ণ সঠিক।”

ট্রাম্প সবসময়ই তার কঠোর ভাবমূর্তি বজায় রাখতে চান।

তিনি লস অ্যাঞ্জেলেসে ৪,০০০ ন্যাশনাল গার্ড সদস্য এবং ৭০০ মেরিন সেনা পাঠিয়েছেন।

দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি আরও বেশি স্বাধীনতা অনুভব করছেন।

অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডি হোয়াইট হাউসের সামনে বলেন, “আমরা আরও কঠোর হতে ভয় পাই না… যদি আমাদের প্রয়োজন হয়।”

তাহলে, এই আগ্রাসী মনোভাব কি ট্রাম্পের জন্য রাজনৈতিকভাবে সফল হবে?

যদি তিনি জনগণকে বোঝাতে পারেন যে পরিস্থিতি সত্যিই গুরুতর, তাহলে তিনি সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সেনা ব্যবহারের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ভাঙার জন্য সমর্থন পেতে পারেন।

ট্রাম্পের ভোটাররা তার এই ধরনের কঠোর মনোভাবে সাড়া দেয়, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

তার নির্বাচনী প্রচারণায়, তার সবচেয়ে কঠোর বক্তব্যগুলোই বেশি সমর্থন পায়।

অভিবাসী ও বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপও তার সমর্থকদের মধ্যে ভালো সাড়া ফেলে।

হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা মনে করেন, ট্রাম্পের কঠোর সীমান্ত নীতি এবং বিতাড়ন পরিকল্পনা আরও বেশি সংখ্যক ভোটারের সমর্থন আদায় করেছে।

তবে এখানে ঝুঁকি হলো, তিনি এমন একটি সংকটের জন্ম দিচ্ছেন যা ছড়িয়ে পড়তে পারে, নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারে এবং এতে জীবনহানিও হতে পারে।

সাম্প্রতিক জরিপগুলো দেখিয়েছে যে, যদিও আমেরিকানরা বিতাড়ন এবং কঠোর সীমান্ত নীতির পক্ষে, তবে তাদের বন্ধু, প্রতিবেশী এবং সমাজের আইন মান্যকারী সদস্যরা যখন বিতাড়নের শিকার হন, তখন তারা একমত হন না।

ডেমোক্র্যাটরা নেতৃত্বহীন অবস্থায় রয়েছে এবং তাদের সুস্পষ্ট কোনো বার্তা নেই।

ট্রাম্পের জনমোহিনী বক্তৃতা এবং বিকল্প বাস্তবতা তৈরির মোকাবিলা করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।

ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গ্যাভিন নিউসাম মঙ্গলবার রাতে ক্যালিফোর্নিয়াবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন, যা সম্ভবত দলের মধ্যে কিছু দিকনির্দেশনা এবং দৃঢ়তা যোগানোর উদ্দেশ্যে ছিল।

নিউসাম যা বলবেন এবং করবেন, তা মূলত এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে হবে যে, তিনি প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান।

তার এবং অন্যান্য ডেমোক্রেট গভর্নরের জন্য, যারা ২০২৮ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা ভাবছেন, এই সংকট সুযোগ এবং বিপদ দুটোই নিয়ে এসেছে।

ডেমোক্রেট নেতারা নিশ্চিত করতে চাইবেন যে, বর্তমান সংকট যেন দলের মধ্যে এমন কোনো প্রতিক্রিয়ার জন্ম না দেয়, যা সাধারণ ভোটারদের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা কমিয়ে দেয়।

২০২০ সালের ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের সময় হওয়া বিক্ষোভ একটি সতর্কবার্তা।

জর্জ ফ্লয়েডকে মিনিয়াপলিসের একজন পুলিশ কর্মকর্তার হাতে হত্যার পর দেশজুড়ে যে বিক্ষোভ হয়েছিল, তার প্রতি অনেক আমেরিকান সমর্থন জানালেও, প্রগতিশীলদের একাংশ থেকে আসা ‘পুলিশের তহবিল বন্ধ করো’র মতো শ্লোগান পরবর্তী নির্বাচনে দলের জন্য রাজনৈতিক বিপর্যয় ডেকে এনেছিল।

তথ্য সূত্র: সিএনএন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *