বিশ্বের সেরা ফুটবলারদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত, নিউজিল্যান্ডের একদল সাধারণ মানুষের অসাধারণ গল্প।
ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে বড় তারকাদের অংশগ্রহণে আসন্ন ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ শুরু হতে চলেছে। লিওনেল মেসি, কিলিয়ান এমবাপ্পে এবং আর্লিং হালান্ডের মতো তারকা খেলোয়াড়রা তাদের ক্লাবের হয়ে মাঠে নামবেন।
তবে, এই টুর্নামেন্টে সকলের নজর এড়িয়ে যাওয়া একটি দল হলো অকল্যান্ড সিটি এফসি। নিউজিল্যান্ডের এই ক্লাবটি মূলত অপেশাদার খেলোয়াড়দের নিয়ে গঠিত।
অকল্যান্ড সিটির খেলোয়াড়রা তাদের ফুটবল ক্যারিয়ারের পাশাপাশি চাকরি বা পড়াশোনা চালিয়ে যান। তাদের মধ্যে কেউ কাজ করেন ফর্কলিফ্ট চালক হিসেবে, কেউবা সফট ড্রিঙ্কস বিক্রি করেন, আবার কেউ রিয়েল এস্টেট এজেন্ট। এই দলের খেলোয়াড়দের কঠোর পরিশ্রম এবং বিশ্ব ক্লাব ফুটবলের শীর্ষ পর্যায়ে তাদের উঠে আসার গল্প যেন হলিউডের সিনেমার চিত্রনাট্যের মতো।
গত বছর ওশেনিয়া চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার মাধ্যমে অকল্যান্ড সিটি ক্লাব বিশ্বকাপের টিকিট নিশ্চিত করে। টুর্নামেন্টে তারা জার্মানির বায়ার্ন মিউনিখ, পর্তুগালের বেনফিকা এবং আর্জেন্টিনার বোকা জুনিয়র্সের মতো শক্তিশালী দলগুলোর সঙ্গে একই গ্রুপে পড়েছে।
অকল্যান্ড সিটির অধিনায়ক মারিও ইলিচ সিএনএন স্পোর্টসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, দলের খেলোয়াড়দের “ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা” তাদের এই ঐতিহাসিক সাফল্যের মূল চালিকাশক্তি। তিনি বলেন, “অনেকে বলেন পেশাদার খেলোয়াড়রা অনেক পরিশ্রম করে, অবশ্যই তারা করে। তবে আমরা একইসঙ্গে দুটি, এমনকি কারো কারো ক্ষেত্রে তিনটি পর্যন্ত কাজ করে শীর্ষ পর্যায়ে খেলার চেষ্টা করছি।”
কোকাকোলা কোম্পানির সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ মারিও ইলিচ তার এবং দলের অন্য খেলোয়াড়দের ব্যস্ত সময়সূচী সম্পর্কে বিস্তারিত জানান। ইউরোপের অনেক এলিট দলের মতো তাদের অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণ সুবিধা নেই। তাই অকল্যান্ড সিটির খেলোয়াড়দের নিজেদের ফিটনেস এবং রিহ্যাবিলিটেশন এর জন্য ক্লাবের বাইরের সুবিধাগুলোর উপর নির্ভর করতে হয়।
ইলিচ তার দৈনন্দিন রুটিন বর্ণনা করে বলেন, “আমার দিন শুরু হয় ভোর ৫টায়। ঘুম থেকে উঠে এক ঘণ্টা শরীরচর্চা করি। এরপর সকালের নাস্তা সেরে অফিসে যাই, যেখানে সকাল ৮টা থেকে কাজ শুরু হয়। চেষ্টা করি বিকাল ৫টার মধ্যে কাজ শেষ করতে, যাতে ৬টায় অনুশীলনে যোগ দিতে পারি। সেখানে দুই ঘণ্টা সময় কাটাই, তারপর রাত ৯টার দিকে বাড়ি ফিরে ঘুমোতে যাই এবং পরের দিনের জন্য প্রস্তুতি নিই।”
অকল্যান্ড সিটি সপ্তাহে চার দিন অনুশীলন করে এবং তাদের লিগের ম্যাচগুলো সাধারণত শনিবার অনুষ্ঠিত হয়। এই ব্যস্ত সময়সূচীর কারণে খেলোয়াড়দের পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে কাটানোর খুব বেশি সময় থাকে না।
ইলিচ বলেন, “আমি আমার সঙ্গীকে সাধারণত শুক্রবার রাতে অথবা রবিবার দিনের কিছু সময় পাই। তবে, সৌভাগ্যবশত সে আমার ক্যারিয়ারের সীমাবদ্ধতা বোঝে এবং আমাকে আমার স্বপ্ন অনুসরণ করতে দেয়।”
অকল্যান্ড সিটির গোলরক্ষক কনার ট্রেসি ক্লাব বিশ্বকাপের ড্রয়ের মুহূর্তটি স্মরণ করে বলেন, “এমন একটি মুহূর্ত কখনো ভোলা যায় না।” তিনি জানান, খেলোয়াড় এবং ম্যানেজমেন্ট সদস্যরা ভোর ৬টায় ক্লাবের অফিসে একত্রিত হয়ে ড্র সরাসরি দেখেছেন।
ট্রেসি আরও বলেন, “প্রতিটি দলের নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সবার মুখ হাঁ হয়ে গিয়েছিল। প্রত্যেক দলেরই ফুটবলে দারুণ ইতিহাস ও খ্যাতি রয়েছে। আমরা যাদের বিরুদ্ধে খেলার সুযোগ পাচ্ছি, তা স্বপ্নের মতোই।”
ভেটেরিনারি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির গুদামে কাজ করা ট্রেসির কাছে এই টুর্নামেন্ট তার ক্যারিয়ারের “সেরা মুহূর্ত”। তবে, ভারী কাজ করার কারণে তিনি মাঝে মাঝে আহত হন।
ট্রেসি বলেন, “আমার কাজটা শারীরিক পরিশ্রমের, যা শরীরের উপর প্রভাব ফেলে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়ার সময় না পাওয়ায় আমি নিয়মিত গোলরক্ষকদের চেয়ে বেশি আহত হই।” তিনি আরও যোগ করেন, “মানসিকভাবে এটা খুবই কঠিন হতে পারে, বিশেষ করে শীতকালে যখন ভোরবেলা এবং রাতে অন্ধকার থাকে।”
অকল্যান্ড সিটির সহ-অধিনায়ক অ্যাডাম মিচেলও এলিট ফুটবলের চাহিদা এবং সাধারণ একটি চাকরির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার কঠিন বিষয়টি অনুভব করেন। তিনি এক সময় ইউরোপিয়ান কাপ জয়ী রেড স্টার বেলগ্রেডে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন, যা তার ছোটবেলার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু পর্যাপ্ত খেলার সুযোগ না পাওয়ায় তিনি স্লোভেনিয়ার একটি ক্লাবে যোগ দেন। এরপর তিনি ইংল্যান্ডের নিম্ন সারির দল বোল্টন ওয়ান্ডারার্সেও খেলেছেন।
মিচেলকে একসময় সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল যে তিনি পেশাদার ফুটবল চালিয়ে যাবেন, নাকি নিউজিল্যান্ডে ফিরে রিয়েল এস্টেট ব্যবসার মাধ্যমে একটি স্থিতিশীল জীবন বেছে নেবেন। শেষ পর্যন্ত, তিনি রিয়েল এস্টেট ব্যবসার দিকে ঝুঁকে পড়েন।
মিচেল সিএনএন স্পোর্টসকে বলেন, “ছোটবেলায় অনেকেরই স্বপ্ন থাকে বড় খেলোয়াড় হওয়ার এবং পেশাদার ফুটবলার হওয়ার। তবে আমি মনে করি, অনেকেই বুঝতে পারে না এটা কতটা কঠিন এবং প্রতিযোগিতামূলক হতে পারে।”
অকল্যান্ড সিটির হয়ে খেলার সুযোগ মিচেলকে তার ফুটবল স্বপ্নকে অন্যভাবে হলেও অনুসরণ করার সুযোগ করে দিয়েছে। বায়ার্নের বিরুদ্ধে দলের প্রথম ম্যাচ শুরুর আগে, এই অভিজ্ঞ ডিফেন্ডার আশা করেন, তাদের পারফরম্যান্স নিউজিল্যান্ডের ক্রীড়া দর্শকদের মধ্যে নতুন উন্মাদনা সৃষ্টি করবে।
মিচেল বলেন, “ছোটবেলায় আমি দক্ষিণ আফ্রিকার ২০১০ বিশ্বকাপ দেখেছি। নিউজিল্যান্ড তিনটি ড্র করায় আমি খুব উচ্ছ্বসিত হয়েছিলাম। ক্লাব পর্যায়েও একই কাজ করার এবং আমাদের দেশ ও অঞ্চলের হয়ে গর্বিত হওয়ার দারুণ সুযোগ রয়েছে।”
বায়ার্ন, বেনফিকা এবং বোকা জুনিয়র্সের মতো দলগুলোতে বিশ্বকাপ জয়ী খেলোয়াড় রয়েছে। ফলে, অকল্যান্ড সিটির খেলোয়াড়দের কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে।
ইলিচ মনে করেন, বায়ার্নের মিডফিল্ডার জোশুয়া কিমিখের বিরুদ্ধে খেলাটা তার জন্য দারুণ অভিজ্ঞতা হবে। তিনি আরও বলেন, “আমি একজন মিডফিল্ডার হিসেবে সবসময় কিমিখের খেলা দেখি, তাই তার বিরুদ্ধে নিজেকে যাচাই করতে পারাটা অসাধারণ হবে।”
গোলরক্ষক ট্রেসি বায়ার্নের “বিপ্লবী” গোলরক্ষক ম্যানুয়েল নয়্যারকে তার আদর্শ মানেন। ডিফেন্সে ভাইস-ক্যাপ্টেন মিচেল ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ গোলদাতা হ্যারি কেইনকে প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুত।
ইলিচ বলেন, “আমরা জানি, আমাদের কাজটি কতটা কঠিন। তারা কোটি কোটি ডলারের মালিক, আর আমরা কেবল ভালোবাসার টানে খেলি। তবে আমরা মাঠে এবং মাঠের বাইরে সবাই বন্ধু এবং একে অপরের জন্য লড়ব। আমাদের কোচের পরিকল্পনা অনুযায়ী খেললে এবং সেরাটা দিলে, কী হয় দেখা যাক। দিনের শেষে, এটা ১১ জনের সঙ্গে ১১ জনের লড়াই। তাই আমরা সেখানে গিয়ে সবসময় যা করি, সেটাই করব: বড় স্বপ্ন দেখব।”
তথ্য সূত্র: সিএনএন