ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি: উত্তেজনার পারদ ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগ।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বর্তমানে আন্তর্জাতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সম্ভাবনা নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব ও ইসরায়েলের উদ্বেগের মধ্যে তেহরান তাদের কার্যক্রমকে শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য উৎসর্গীকৃত বলে দাবি করছে।
সম্প্রতি, ইরানের অভ্যন্তরে কয়েকটি স্থানে হামলার খবর পাওয়া গেছে, যা এই অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ইতিহাস বেশ পুরনো। ১৯৫০-এর দশকে, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় দেশটি এই খাতে প্রবেশ করে।
১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর, পশ্চিমা দেশগুলো ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে, কারণ তাদের আশঙ্কা ছিল, ইরান সম্ভবত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চাইছে। ইরান অবশ্য বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (IAEA)-এর সঙ্গে সহযোগিতা বজায় রাখার কথা জানিয়েছে।
তবে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ কমানোর জন্য ২০১৫ সালে ইরান ও বিশ্বের ক্ষমতাধর কয়েকটি দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
এই চুক্তি অনুযায়ী, ইরান তাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা কমিয়ে আনতে এবং পরমাণু কর্মসূচি সীমিত করতে রাজি হয়, যার বিনিময়ে ইরানের ওপর থেকে কিছু অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।
কিন্তু ২০১৮ সালে, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন এবং ইরানের বিরুদ্ধে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এরপর থেকে, তেহরান ধীরে ধীরে চুক্তির শর্তগুলো লঙ্ঘন করতে শুরু করে এবং ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের পরিমাণ বাড়াতে থাকে।
ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রক্রিয়াটি পরমাণু অস্ত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাকৃতিক ইউরেনিয়ামে ইউরেনিয়াম-২৩৫-এর পরিমাণ খুবই কম থাকে, যা পারমাণবিক বিক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয়।
এই ইউরেনিয়াম-২৩৫-এর পরিমাণ বৃদ্ধি করার প্রক্রিয়াকে সমৃদ্ধকরণ বলা হয়।
বিদ্যুতের জন্য ব্যবহৃত পারমাণবিক চুল্লিতে সাধারণত ৩.৫% থেকে ৫% পর্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ব্যবহার করা হয়, যেখানে একটি পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য প্রায় ৯০% পর্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম প্রয়োজন।
বর্তমানে, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, ইরান ৬০% পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে, যা বোমা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রার কাছাকাছি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (IAEA) জানিয়েছে, ইরানের কাছে বর্তমানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ৬০% সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুদ রয়েছে, যা সম্ভবত কয়েকটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য যথেষ্ট।
ইরানের পরমাণু কেন্দ্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নাতানজ। এখানে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মূল কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
সম্প্রতি, ইসরায়েল নাতানজে হামলা চালিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
এছাড়া, ইরানের অন্যান্য কিছু পরমাণু কেন্দ্রেও হামলার খবর পাওয়া গেছে।
ইরানের পক্ষ থেকে এসব হামলার তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে এবং এর প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইরানের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা করছে।
তবে, দুই পক্ষের অনড় অবস্থানের কারণে আলোচনা ফলপ্রসূ হচ্ছে না।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে সৃষ্ট এই সংকট আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
এটি কেবল মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতাকেই হুমকির মুখে ফেলছে না, বরং পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধের আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাকেও দুর্বল করে দিচ্ছে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন