চীনের নৌ-সামরিক শক্তি বৃদ্ধি: প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের রণতরীর মহড়া, বাড়ছে উদ্বেগ
গত এক মাসে চীন তাদের সামরিক শক্তি প্রদর্শনের অংশ হিসেবে প্রশান্ত মহাসাগরে নৌ মহড়া জোরদার করেছে। এই মহড়াগুলোতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে এবং এর মাধ্যমে তারা নিজেদের সামরিক সক্ষমতা জানান দিচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, চীন এই মহড়ার মাধ্যমে একটি শক্তিশালী বার্তা দিতে চাইছে।
চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি নেভি (PLAN) এর একটি বহর, যার নেতৃত্বে ছিল ‘শানডং’ নামের একটি বিমানবাহী রণতরী, ফিলিপাইনের উত্তরে মহড়া চালিয়েছে। এছাড়া, চীনের নতুন বিমানবাহী রণতরী ‘ফুজিয়ান’ কোরীয় উপদ্বীপের পশ্চিমে, বিতর্কিত জলসীমায় সমুদ্র trial-এ অংশ নিয়েছে। চীনের সবচেয়ে পুরনো বিমানবাহী রণতরী ‘লিয়াওনিং’ জাপানের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে মহড়া পরিচালনা করেছে।
সামরিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, মহড়া চলাকালীন সময়ে ‘ফুজিয়ান’ প্রথমবারের মতো তার অত্যাধুনিক ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ক্যাটাপল্ট সিস্টেম (EMALS) ব্যবহার করে সমুদ্র থেকে বিমানের উড্ডয়ন ও অবতরণ করিয়েছে। এই প্রযুক্তিগত উন্নতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কারণ, বিশ্বে এই সিস্টেম আছে এমন রণতরীর সংখ্যা খুবই কম। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর নতুন বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড-এ এই সিস্টেমটি বিদ্যমান।
গত সোমবার জাপানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, ‘শানডং’ এবং এর সহযোগী জাহাজগুলো ওকিনাওয়া প্রদেশের দক্ষিণে অবস্থিত মিয়াকো দ্বীপের কাছে মহড়া চালিয়েছে। এর ফলে প্রথমবারের মতো দুটি চীনা বিমানবাহী রণতরী দল একসাথে প্রশান্ত মহাসাগরে মহড়া চালায়।
এই মহড়ার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল তাইওয়ান। চীন তাইওয়ানকে তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করে এবং প্রয়োজনে সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে তাইওয়ানকে চীনের সাথে একত্রিত করার কথা জানিয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তাইওয়ানকে চীনের সঙ্গে ‘পুনর্মিলন’ করার অঙ্গীকার করেছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রশান্ত মহাসাগরে এই মহড়াগুলো এমন কিছু এলাকার ওপর দিয়ে গেছে, যেখান দিয়ে তাইওয়ানকে সামরিক সহায়তা প্রদানের জন্য মার্কিন নৌবহরকে যেতে হবে। তাইওয়ানের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মে মাসে PLAN নিয়মিতভাবে প্রায় ৭০টি যুদ্ধজাহাজ ও উপকূলরক্ষী জাহাজ মোতায়েন করেছে, যা বোহাই সাগর থেকে শুরু করে তাইওয়ান প্রণালী এবং দক্ষিণ চীন সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিবের মতে, চীন দক্ষিণ চীন সাগর এবং প্রথম দ্বীপ শৃঙ্খলে স্থিতাবস্থা পরিবর্তনের একতরফা চেষ্টা চালাচ্ছে। এই অঞ্চলে চীনের সামরিক উপস্থিতি বাড়ছে এবং তারা তাইওয়ান সহ আশেপাশের দেশগুলোকে ভয় দেখানোর কৌশল অবলম্বন করছে।
জাপানি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চীন সম্ভবত তাদের বিমানবাহী রণতরীর পরিচালনা ক্ষমতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে এবং সমুদ্রের দূরবর্তী অঞ্চলে অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।
চীনের এই পদক্ষেপের মাধ্যমে তারা তাদের ক্রমবর্ধমান নৌ-সামরিক শক্তির জানান দিচ্ছে এবং প্রয়োজনে তা ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বর্তমানে, যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর পরেই চীনের নৌবাহিনী বিশ্বের বৃহত্তম নৌবাহিনী হিসেবে পরিচিত। সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, চীনের এই পদক্ষেপগুলো কেবল প্রশিক্ষণ বা মহড়া নয়, বরং এর মাধ্যমে চীন একটি শক্তিশালী বার্তা দিচ্ছে যে তারা তাদের জলসীমায় সামরিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে প্রস্তুত।
চীনের নতুন বিমানবাহী রণতরী ‘ফুজিয়ান’-এর এই অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা রয়েছে। এটি প্রায় ৮০,০০০ টন ওজনের এবং প্রায় ৫০টি বিমান বহন করতে সক্ষম। ‘ফুজিয়ান’ -এ ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ক্যাটাপল্ট সিস্টেম ব্যবহার করার ফলে এটি পুরনো রণতরীগুলোর চেয়ে বেশি ওজনের অস্ত্র ও জ্বালানি নিয়ে উড়তে পারে।
এর ফলে ‘ফুজিয়ান’-এর বিমানগুলো শত্রুদের ওপর দূর থেকে আঘাত হানতে পারবে।
সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন দ্রুত তাদের নৌবহরকে আধুনিকীকরণ করছে এবং নতুন জাহাজ ও বিমান তৈরি করছে।
তবে, চীনের সামরিক সক্ষমতা নিয়ে এখনই অতিরিক্ত মূল্যায়ন করা ঠিক হবে না। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র কয়েক দশক ধরে সুদূর সমুদ্রে বিমানবাহী রণতরী পরিচালনা করে আসছে। তাই এই ক্ষেত্রে চীনের এখনো অনেক কিছু শেখার আছে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন