স্মৃতিশক্তি বাড়াতে প্রাচীন কৌশল! বৃদ্ধ বয়সেও স্মৃতি সতেজ!

স্মৃতিশক্তি বাড়াতে প্রাচীন এক কৌশল: আপনার মস্তিষ্কের অন্দরমহল

স্মৃতিশক্তি, মানুষের মস্তিষ্কের এক অমূল্য সম্পদ। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, পড়াশোনা থেকে শুরু করে কর্মজীবন, এমনকি সামাজিক সম্পর্ক—সবকিছুতেই এর গুরুত্ব অপরিসীম।

দুর্বল স্মৃতিশক্তি অনেক সময় আমাদের উদ্বেগের কারণ হয়। তবে, বিজ্ঞানীরা যুগ যুগ ধরে চলে আসা এমন এক কৌশল আবিষ্কার করেছেন, যা স্মৃতিশক্তিকে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করতে পারে।

এই কৌশলটির নাম হলো ‘মেথড অফ লোকি’ (Method of Loci), যা ‘মেমোরি প্যালেস’ (Memory Palace) বা ‘রোমান রুম’ (Roman Room) পদ্ধতি নামেও পরিচিত।

এই পদ্ধতির মূল ধারণাটি বেশ সহজ: পরিচিত কোনো স্থানকে স্মৃতি ধারণের একটি স্থানে পরিণত করা। ধরা যাক, আপনি আপনার মুদিখানার তালিকা মনে রাখতে চান।

সেক্ষেত্রে, আপনার বসার ঘরের ছবিটির সাথে দুধকে এবং জানালাটির সাথে আপেলকে একটি বিশেষ পদ্ধতিতে যুক্ত করতে পারেন।

এই সংযোগগুলো হতে হবে কল্পনাপ্রসূত, উদ্ভট ও আকর্ষণীয়। প্রাচীন রোমান বক্তা সিসেরো তার বক্তৃতা মনে রাখার জন্য এই কৌশল ব্যবহার করতেন।

বর্তমানে, প্রতিযোগিতামূলক ‘মেমোরি অ্যাথলেট’রা এই কৌশল ব্যবহার করে হাজার হাজার তথ্য মনে রাখেন। এমনকি, স্মৃতিভ্রংশ রোগীদের স্মৃতিশক্তি পুনরুদ্ধারে, মস্তিষ্কের আঘাত থেকে সেরে উঠতে এবং বিষণ্ণতা ও মানসিক আঘাতের চিকিৎসায়ও এই পদ্ধতি সহায়ক হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ‘মেমোরি চ্যাম্পিয়নশিপ’-এর প্রতিযোগীরা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে শত শত শব্দ, মানুষের জীবনের গল্প, এমনকি তাসের খেলার ক্রমও মনে রাখতে পারেন।

তারা সবাই ‘মেথড অফ লোকি’-এর বিভিন্ন রূপ ব্যবহার করেন। এই পদ্ধতির উদ্ভাবন সম্পর্কে একটি কিংবদন্তি প্রচলিত আছে।

প্রাচীন গ্রিক কবি সাইমনাইডিস অফ সিওস-এর একটি ঘটনা থেকে এর সূত্রপাত।

ভূমিকম্পে একটি ভবন ধসে যাওয়ার পরে, তিনি সেখানে উপস্থিত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন, কারণ তিনি তাদের বসার স্থান মনে রেখেছিলেন।

প্রাচীন সংস্কৃতিতেও এই ধরনের কৌশল প্রচলিত ছিল। আদিবাসী আমেরিকান তীর্থযাত্রীদের পথ, অস্ট্রেলীয় আদিবাসীদের গান এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপবাসীদের অনুষ্ঠানে এই পদ্ধতির ব্যবহার দেখা যায়।

তাদের ধর্মীয় গুরুরা নির্দিষ্ট স্থানে গান, নৃত্য বা গল্প বলার মাধ্যমে তথ্যকে স্থান ও ঘটনার সাথে যুক্ত করতেন।

মস্তিষ্কের গঠন এবং কার্যকারিতা:

বিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘মেথড অফ লোকি’ আমাদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্রমের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

স্থানিক ধারণা এবং দৃশ্যমান স্মৃতি—এই দুটি বিষয়ে আমাদের মস্তিষ্ক খুবই দক্ষ।

‘মেথড অফ লোকি’ এই দুটি ক্ষমতাকে কাজে লাগায়।

মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স, হিপোক্যাম্পাস এবং ভিজ্যুয়াল কর্টেক্স—এই তিনটি অংশকে যুক্ত করে স্মৃতি আরও শক্তিশালী করা যায়।

স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর নতুন দিগন্ত:

ফ্লোরিডার একটি বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের জন্য এই কৌশল শেখানো হয়। সেখানে, শারীরিক কার্যকলাপ, সামাজিক মিথস্ক্রিয়া এবং ‘মেথড অফ লোকি’-এর মতো কৌশল ব্যবহার করে তাদের স্মৃতিশক্তিকে ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়।

এই পদ্ধতির মাধ্যমে বয়স্ক ব্যক্তিরা নতুন করে জীবন ফিরে পাচ্ছেন।

চিকিৎসা ও পুনর্বাসন:

চিকিৎসকরা মস্তিষ্কের আঘাত, মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস, এইচআইভি-সংক্রান্ত জ্ঞানীয় দুর্বলতা এবং মেরুরজ্জুর আঘাতের কারণে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা কমে যাওয়া রোগীদের চিকিৎসায় এই পদ্ধতি ব্যবহার করছেন।

বিষণ্ণতা ও মানসিক আঘাতের শিকার ব্যক্তিরাও এই পদ্ধতির মাধ্যমে উপকৃত হতে পারেন, কারণ এটি তাদের ইতিবাচক স্মৃতিগুলো মনে রাখতে সাহায্য করে।

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ:

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই কৌশলটি শুধুমাত্র বয়স্ক বা স্মৃতিশক্তি দুর্বল ব্যক্তিদের জন্য নয়, বরং সবার জন্যই উপকারী।

নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে স্মৃতিশক্তিকে উন্নত করা সম্ভব।

আপনি আপনার পড়াশোনার সুবিধার জন্য, পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য, বা আপনার দৈনন্দিন জীবনের স্মৃতিগুলোকে আরও ভালোভাবে ধরে রাখার জন্য এই কৌশল ব্যবহার করতে পারেন।

স্মার্টফোনের যুগে যখন আমরা গুগল বা জিপিএসের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি, তখন এই প্রাচীন কৌশলগুলো আমাদের মস্তিষ্কের অসাধারণ ক্ষমতা সম্পর্কে নতুন করে ধারণা দেয়।

তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *