আশ্চর্যজনক! ধর্মপ্রচার থেকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া কর্মী, কেমন ছিল সন্দেহভাজনের জীবন?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক চাঞ্চল্যকর ঘটনায়, মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের এক আইনপ্রণেতা ও তাঁর স্বামীর হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন এক ব্যক্তি। অভিযুক্ত ভ্যান্স বোয়েল্টার-এর জীবনযাত্রা ছিল বহুমাত্রিক, যা অনেকের কাছেই ছিল বিস্ময়কর।

কর্পোরেট জগৎ থেকে ধর্মপ্রচারক, পরবর্তীতে আফ্রিকার বিভিন্ন ব্যবসা, এমন বিচিত্র অভিজ্ঞতার সাক্ষী ছিলেন তিনি। ঘটনার তদন্ত এখনো চলছে, আর এর মাঝেই বোয়েল্টারের জীবন নিয়ে উঠছে নানা প্রশ্ন।

বোয়েল্টার দীর্ঘদিন ধরে খাদ্য পরিষেবা প্রদানকারী বিভিন্ন সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। উইসকনসিন ও মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যে তাঁর ছিল একাধিক বাড়ি, পরিবারে ছিল পাঁচ সন্তান ও দুটি জার্মান শেফার্ড কুকুর।

আপাতদৃষ্টিতে তিনি ছিলেন একজন সফল আমেরিকান নাগরিক। কিন্তু ২০২১ সালে তিনি সবকিছু ছেড়ে কঙ্গোতে পাড়ি জমান, বিশ্ব থেকে ক্ষুধা দূর করার ব্রত নিয়ে।

এরপর মাঝেমধ্যেই তিনি মধ্য আফ্রিকায় যেতেন ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। এই ভ্রমণের খরচ যোগাতে তিনি মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের কিছু অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া কেন্দ্রে কাজ করতেন, এমনকি অপরাধের স্থান থেকে মৃতদেহ সংগ্রহ করতেও দেখা গেছে তাঁকে।

পুলিশ যখন মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের আইনপ্রণেতা ও তাঁর স্বামীর হত্যাকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান করছে, তখন বোয়েল্টারের জীবনের এই বিচিত্র দিকগুলো সামনে আসছে। তদন্তকারীরা বলছেন, বোয়েল্টার আগে থেকে নির্বাচিত কর্মকর্তাদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন।

বোয়েল্টারের পরিচিতরা বলছেন, তিনি বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছিলেন, যার মধ্যে ছিল মিনেসোটাতে একটি সশস্ত্র নিরাপত্তা সংস্থা এবং কঙ্গোতে একটি মৎস্য ও কৃষি ফার্ম।

বোয়েল্টারের এক রুমমেট জানিয়েছেন, ব্যবসার অবনতির কারণে তিনি ক্রমশ আর্থিক সংকটে পড়ছিলেন। এমনকি আগের জীবনযাত্রার ধারা বজায় রাখতেও হিমশিম খাচ্ছিলেন।

মিনিয়াপলিসের কাছে গ্রিন আইলে তাঁর প্রায় ৪ লক্ষ ডলার মূল্যের একটি বাড়ি ছিল, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৪ কোটি ৭০ লক্ষ টাকার সমান। পরিবারের ভরণপোষণের খরচ যোগাতেও সমস্যা হচ্ছিল তাঁর।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, বোয়েল্টার যে এমন একটি ভয়ংকর ঘটনার পরিকল্পনা করছিলেন, তার কোনো ইঙ্গিত তাঁর আচরণে ছিল না। ফেডারেল অভিযোগ অনুযায়ী, শনিবার ভোরে বোয়েল্টার পুলিশের পোশাক পরে চারজন ডেমোক্রেট জনপ্রতিনিধির বাড়িতে যান।

সেখানে তিনি স্টেট রেপ. মেলিসা হর্টম্যান ও তাঁর স্বামীকে গুলি করে হত্যা করেন এবং স্টেট সেন. জন হফম্যান ও তাঁর স্ত্রীকে আহত করেন। বোয়েল্টারের বাড়ি ও গাড়িতে “মিনেসোটার বহু জনপ্রতিনিধির নাম ও ঠিকানা সম্বলিত হাতে লেখা তালিকা” পাওয়া গেছে।

ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পরেই বোয়েল্টার তাঁর স্ত্রী ও পরিবারের কাছে একটি বার্তা পাঠান, যেখানে তিনি লেখেন, “বাবা আজ রাতে যুদ্ধে গিয়েছিলেন”। সরকারি নথিপত্র অনুযায়ী, বোয়েল্টার একসময় রিপাবলিকান হিসেবে নিবন্ধিত ছিলেন এবং প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোটও দিয়েছেন।

তবে তাঁর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাজনীতির তেমন কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। বোয়েল্টারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছেন এমন চারজন জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তাঁর মধ্যে কোনো রাজনৈতিক উগ্রতা দেখা যায়নি।

আফ্রিকার একটি চার্চে দেওয়া ভাষণে বোয়েল্টার তাঁর জীবন নিয়ে নতুন কিছু করার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “আমি যখন মারা যাব এবং স্বর্গে যাব…আমি অন্যদের গল্প শুনতে চাই না, বরং আমার নিজের কিছু বলার মতো গল্প থাকতে হবে।”

বোয়েল্টারের লিঙ্কডইন প্রোফাইল তাঁর জীবনের এই পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। সেখানে খাদ্য পরিষেবা প্রদানকারী বিভিন্ন সংস্থায় তাঁর কাজের উল্লেখ আছে, কিন্তু ২০২১ সালে কঙ্গোতে তিনি একটি নতুন কোম্পানি শুরু করেন।

তিনি উইসকনসিনের একটি বেবি ফুড প্ল্যান্ট এবং একটি সসেজ কোম্পানিতে সুপারভাইজার ও ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছেন। মিনেসোটাতে থাকাকালীন তিনি কর্মসংস্থান উন্নয়নে অবদানের জন্য একটি স্থানীয় পুরস্কারও পেয়েছিলেন।

বোয়েল্টার ১৯৯৩ সালে রেভারেন্ড হিসেবে অভিষিক্ত হন। তিনি একটি খ্রিস্টান দাতব্য সংস্থা ‘রেভোফরমেশন মিনিস্ট্রিজ’ শুরু করেছিলেন। বন্ধুদের সঙ্গে তিনি মিশরে গিয়ে সুসমাচার বিতরণ করেছেন বলেও জানা যায়।

বোয়েল্টারের স্ত্রী জেনি বোয়েল্টার ২০১৮ সালে ‘প্রিটোরিয়ান গার্ড সিকিউরিটি সার্ভিসেস এলএলসি’ নামে একটি সংস্থা তৈরি করেন। এই সংস্থাটি সশস্ত্র নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগের লাইসেন্সপ্রাপ্ত।

কিন্তু ২০১৯ সালের এক নথিতে জেনি বোয়েল্টার লিখেছিলেন, “কোম্পানিটি চালু করার ঠিক আগে মহামারী শুরু হয়। হাজার হাজার ডলার খরচ করেও ব্যবসার কাজ সেভাবে শুরু করা যায়নি।”

বোয়েল্টারের পরিচিত একজন জানান, তিনি একটি “সামাজিক অস্থিরতা” পরিস্থিতিতে ব্যয়বহুল ব্যক্তিগত সুরক্ষা প্রদানের পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন, যা বাস্তবসম্মত ছিল না।

২০২১ সালে বোয়েল্টার তাঁর চাকরি ছেড়ে আফ্রিকার উন্নয়নে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি কঙ্গোতে যান এবং সেখানকার খাদ্য সরবরাহ উন্নত করার পরিকল্পনা করেন।

পরে তিনি নিজে সেখানে “কৃষি ও মৎস্য প্রকল্প” শুরু করেন। তিনি ‘রেড লায়ন গ্রুপ’ নামে একটি সংস্থা তৈরি করেন, যা কঙ্গোতে প্রথম মডুলার তেল শোধনাগার, কাঁচ তৈরির কারখানা এবং লগিং কোম্পানি তৈরির পরিকল্পনা করেছিল।

বোয়েল্টারের এই পদক্ষেপ তাঁর বন্ধুদের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি করে। তাঁর পরিচিতরা জানান, এই প্রকল্পের কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা ছিল না।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বোয়েল্টার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া কেন্দ্রে কাজ শুরু করেন। তাঁর ভাষ্যমতে, আফ্রিকার প্রকল্পগুলোর জন্য অর্থ জোগাড় করতে এবং সময়ের সাথে সঙ্গতি রেখে কাজ করার জন্য তিনি এই পেশা বেছে নিয়েছিলেন।

এই ঘটনার পর বোয়েল্টারের পরিচিতরা হতবাক। তাঁদের চোখে বোয়েল্টার ছিলেন অন্যরকম, আর এখন পুলিশের বর্ণনায় তিনি একজন ঠান্ডা মাথার খুনি।

তথ্যসূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *