উত্তর কোরিয়ার কোভিড-১৯ পরিস্থিতি: সরকারি দাবির বিপরীতে ভয়াবহ চিত্র।
বিশ্বজুড়ে যখন কোভিড-১৯ মহামারি আঘাত হেনেছিল, উত্তর কোরিয়া তখন দাবি করেছিল তাদের দেশে কোনো আক্রান্তের খবর নেই। কিন্তু সম্প্রতি একটি নতুন প্রতিবেদনে দেশটির ভেতরের পরিস্থিতি ভিন্নভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (CSIS) এবং জর্জ ডব্লিউ বুশ ইনস্টিটিউটের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, কিভাবে সাধারণ নাগরিকেরা মহামারীর সময় কঠিন পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উত্তর কোরিয়ার সরকার যদিও প্রথম দিকে কোনো আক্রান্তের খবর অস্বীকার করেছে, বাস্তবে পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। গোপনীয়তার চাদরে মোড়া দেশটির অভ্যন্তরে, কোভিড-১৯ ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং এতে আক্রান্তদের চিকিৎসার সুযোগ ছিল খুবই কম।
অনুসন্ধানকারীরা দেশটির ভেতরে গোপনে প্রায় একশ জনের সঙ্গে কথা বলেছেন। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে এই সাক্ষাৎকারগুলো নেওয়া হয়।
সাক্ষাৎকারদাতাদের মধ্যে দেশটির ৯টি প্রদেশ ও রাজধানী পিয়ংইয়ং-এর বাসিন্দারা ছিলেন। সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, কিভাবে সরকারি মিথ্যাচারের কারণে সাধারণ মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়েছিলেন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আক্রান্তদের মধ্যে অনেকেই হয় ভেজাল ওষুধ খেয়ে অথবা কোনো চিকিৎসা ছাড়াই মারা গেছেন। এমনকি চিকিৎসকরাও রোগীদের মিথ্যা কথা বলতে বাধ্য হতেন।
গ্রামের নেতারাও দলীয় কর্মকর্তাদের কাছে তথ্য গোপন করতেন, আর সরকার তো পুরোটাই অস্বীকার করে যাচ্ছিল।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, দেশটির ৯২ শতাংশ মানুষ হয় সংক্রমিত হয়েছিলেন, না হয় তাদের পরিবারের কোনো সদস্য আক্রান্ত হয়েছিলেন। অধিকাংশ উত্তরদাতারা জানিয়েছেন, ২০২০ এবং ২০২১ সালে সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি ছিল।
অনেক মানুষ অল্প সময়ের মধ্যে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
চিকিৎসার অভাবে রোগীরা বিভিন্ন ধরনের ঘরোয়া পদ্ধতির ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়েছিলেন। লবণ জল দিয়ে গার্গল করা, গলায় রসুনের মালা পরা, এমনকী আফিমের ইনজেকশন নেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে।
পর্যাপ্ত ঔষধের অভাবে অনেককে ভেজাল ওষুধ ব্যবহার করতে হয়েছে, যার ফলে অনেকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন।
সরকার মাস্ক বিতরণেও ব্যর্থ হয়েছিল। মাত্র ৮ শতাংশ মানুষ সরকারিভাবে মাস্ক পেয়েছিলেন।
অনেকে নিজেরাই মাস্ক তৈরি করতে অথবা কালোবাজার থেকে চড়া দামে কিনতে বাধ্য হয়েছিলেন।
কোভিড-১৯ এর সময় খাদ্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। জরিপে অংশ নেওয়া ৮১ শতাংশ মানুষ খাদ্য সংকটের কথা জানিয়েছেন।
জরুরি অবস্থায় খাবার না থাকায় কোয়ারেন্টিনে থাকা মানুষেরা চরম দুর্ভোগে পড়েন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কোভিড পরীক্ষার সুযোগ ছিল খুবই সীমিত। ৮৭ শতাংশ মানুষের কোনো পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল না।
ভ্যাকসিনেশনও ছিল খুবই কম। চীনের সহায়তায় ২০২২ সালে কিছু ভ্যাকসিন এলেও, তা প্রয়োজনের তুলনায় ছিল খুবই সামান্য।
এই পরিস্থিতিতে, অসুস্থতা সম্পর্কে তথ্য দেওয়াটাও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। স্থানীয় ক্লিনিক এবং পাড়া-মহল্লার কর্মকর্তাদের আক্রান্তের খবর কেন্দ্রে জানাতে হতো।
কিন্তু মাত্র ৪১ শতাংশ মানুষ তাদের রিপোর্টের ফলাফল সম্পর্কে কোনো তথ্য পেয়েছেন।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, উত্তর কোরিয়ার জনগণের মধ্যে সরকারের প্রতি চরম অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। অনেকে বলেছিলেন, “আমাদের দেশ পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে পারে, কিন্তু আমাদের ভ্যাকসিন দিতে পারে না।”
৮৩ শতাংশ উত্তরদাতার অভিজ্ঞতা সরকারের প্রচারণার সঙ্গে মিল ছিল না। অর্ধেকের বেশি মানুষ সরকারের কোভিড-১৯ বিষয়ক ঘোষণার ওপর আস্থা রাখতে পারেননি।
তথ্য সূত্র: সিএনএন