ইরানে আবার যুদ্ধ? ট্রাম্পের এই চালে কী হবে?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি আবার মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে? এমন এক আশঙ্কা ক্রমশ জোরালো হচ্ছে, কিন্তু এই যুদ্ধের শেষ কোথায়, সে বিষয়ে কারও কোনো সুস্পষ্ট ধারণা নেই। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সিএনএন-এর এক প্রতিবেদনে এমনটাই উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন ঘটনা, গণবিধ্বংসী অস্ত্রের বিস্তার এবং নিজের কথার সম্মান রাখার তাগিদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্ভবত ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ওপর আঘাত হানতে ইসরায়েলের আহ্বানে সাড়া দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বিশেষ বোমা (“Massive Ordnance Penetrator”) দিয়ে চালানো হবে।

ওয়াশিংটনে এমন আলোচনা বাড়ছে যে, ট্রাম্প দ্রুতই ইরানের পরমাণু স্থাপনায় আঘাত হানার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এর আগে ইরানের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধানে পৌঁছানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। এমনকি, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাম্প্রতিক কথাবার্তায়ও কঠোর মনোভাব দেখা যাচ্ছে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ট্রাম্প হয়তো ইরানকে আলোচনার টেবিলে ফেরাতে চাইছেন, অথবা তার ‘শর্তহীন আত্মসমর্পণের’ পুরনো দাবি আদায়ের চেষ্টা করছেন। তবে আন্তর্জাতিক সংকট গবেষণা গ্রুপের ইরান প্রকল্পের পরিচালক আলী ভায-এর মতে, “ট্রাম্প যদি ইরানের ওপর ইসরায়েলের আগ্রাসনকে পুঁজি করে দেশটির নেতৃত্বকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে চান, তাহলে এটা কোনো কাজে আসবে না।” তিনি আরও যোগ করেন, এমনটা হলে শেষ পর্যন্ত ইরানের সরকার পতনের সম্ভবনা রয়েছে।

ইসরায়েল যদি যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বানচাল করার উদ্দেশ্যে এমনটা করে থাকে, তাহলে এমন একজন প্রেসিডেন্ট, যিনি সম্প্রতি রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন এবং চীনের শি জিনপিংয়ের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন, তিনি কিভাবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে থামাতে পারবেন?

তবে ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ তার নিজের রাজনৈতিক আদর্শের পরিপন্থী হতে পারে। কারণ, ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে তিনি ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যুক্ত হওয়াকে ‘ভয়ংকর ভুল’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। ক্ষমতায় আসার পর তিনি ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি অনুসরণ করেছেন, যা তাকে এক ভিন্ন পথে চালিত করবে।

অন্যদিকে, ইরানের পরমাণু অস্ত্র তৈরি করার সম্ভাবনা সব সময়ই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগের কারণ। ট্রাম্প হয়তো মনে করেন, ইরানের পরমাণু অস্ত্র তৈরি রুখতে না পারলে যুক্তরাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি সৃষ্টি হবে।

কিন্তু অতীতের দিকে তাকালে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপগুলো খুব একটা সফল হয়নি। ২০০৩ সালে ইরাকে অভিযান চালিয়ে সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলেও দেশটির রাজনৈতিক কাঠামো ভেঙে যায়। এর ফলশ্রুতিতে সেখানে সহিংসতা বেড়ে যায়। একইভাবে, আফগানিস্তানেও দুই দশক ধরে চলা মার্কিন সামরিক অভিযান দেশটির নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তোলে।

লিবিয়ার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল। ২০১১ সালে পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থনে মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে উৎখাত করা হলেও দেশটি আজও চরম দারিদ্র্যের মধ্যে রয়েছে।

অতীতে যুক্তরাষ্ট্রের এমন ব্যর্থতাগুলো ট্রাম্প ভালো করেই জানেন। ২০১৬ সালের এক বিতর্কে তিনি বলেছিলেন, “তথাকথিত নীতিনির্ধারকরা একটি জাতির চেয়ে অনেক বেশি ধ্বংস করেছে।” এখন প্রশ্ন হলো, তিনি কি সেই একই পথে হাঁটতে যাচ্ছেন?

ইরান যদি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। তারা হয়তো হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে বিশ্ববাজারে তেলের সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে। এছাড়া, তারা সৌদি আরবের মতো আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপরও হামলা চালাতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রকে হয়তো আরও গভীরভাবে এই যুদ্ধে জড়াতে হতে পারে। ইরানের সাইবার হামলাও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে।

যদি ইসরায়েল ইরানের সরকার পরিবর্তনে সফল হয়, সেক্ষেত্রে দেশটির অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। প্রায় ৯ কোটি মানুষের এই দেশে জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক বিভেদ রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে অরাজকতা সৃষ্টি হতে পারে এবং লাখ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিতে পারে। এর ফলে, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে অভিবাসন সংকট আরও বাড়বে।

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলার পর সেখানকার তেজস্ক্রিয় পদার্থ সন্ত্রাসীদের হাতে চলে যেতে পারে।

তবে ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের এমন কঠোর অবস্থানের পেছনে দেশটির নিজস্ব যুক্তি রয়েছে। তারা মনে করে, ইরানের পরমাণু বোমা তৈরি হলে তা ইসরায়েলের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের যৌথ সামরিক অভিযান সবসময় সফল হয়নি। গাজায় হামাসকে নির্মূল করতে ইসরায়েল এখনো পর্যন্ত সফল হয়নি। ইরানের ক্ষেত্রেও একই ধরনের চ্যালেঞ্জ দেখা যেতে পারে।

ট্রাম্প সম্ভবত ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংস করার জন্য সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছেন, কারণ তিনি মনে করেন, এর মাধ্যমে তিনি দ্রুত একটি ‘যুদ্ধ জয়’ করতে পারবেন। এছাড়া, তিনি দেখাতে চাইছেন যে, তিনি বুশ, ওবামা বা বাইডেনের চেয়ে ভালো কাজ করতে পারেন।

কিন্তু ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। কারণ, তিনি সম্ভবত এমন একটি অঞ্চলে সামরিক হস্তক্ষেপ করতে যাচ্ছেন, যেখানে অতীতে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সেনা নিহত হয়েছে এবং বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যিই ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেয়, তাহলে যুদ্ধের শেষ কোথায়, সে বিষয়ে এখনো পর্যন্ত কোনো সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *