ডেট্ৰয়েট: পুনৰুজ্জীবনে কলাৰ উজ্জ্বল নক্ষত্ৰ, বিশ্বজুৰি চৰ্চা!

যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়েট: এক সময়ের শিল্পনগরী থেকে সংস্কৃতি ও উদ্ভাবনের কেন্দ্র।

যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যের ডেট্রয়েট শহরের গল্পটা যেন এক রূপকথার মতো। এককালে যা ছিল আমেরিকার অর্থনীতির কেন্দ্র, গাড়ির কারখানায় ঠাসা এক ব্যস্ত শহর, সময়ের পরিক্রমায় সেই ডেট্রয়েটই যেন হারিয়ে গিয়েছিল।

শিল্পায়ন, অর্থনৈতিক মন্দা আর সামাজিক অস্থিরতা – সব মিলে শহরটি একসময় পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে। কিন্তু হার না মানা মানুষের অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর নতুন করে জেগে উঠবার স্বপ্নে আজ ডেট্রয়েট আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।

বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে, ডেট্রয়েট ছিল গাড়ির উৎপাদন শিল্পের প্রাণকেন্দ্র। ফোর্ড, জেনারেল মোটরস-এর মতো কোম্পানিগুলোর কারখানাগুলোতে কাজ করতেন হাজারো শ্রমিক। সেই সময়ে ডেট্রয়েট ছিল বিশ্বের অন্যতম ধনী শহর।

কিন্তু সময়ের সাথে সাথে প্রযুক্তির পরিবর্তন, কারখানার স্বয়ংক্রিয়করণ এবং উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য অন্য দেশে কারখানা স্থানান্তরের ফলে এই শহরের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগে। বহু মানুষ কাজ হারান, শহরের অনেক এলাকা পরিত্যক্ত হয়ে যায়।

সেই সাথে যুক্ত হয়েছিল বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা, যা ডেট্রয়েটকে এক কঠিন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়।

তবে, ডেট্রয়েটের মানুষ হাল ছাড়েননি। তারা নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। শহরের পরিত্যক্ত এলাকাগুলোতে ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে নতুন শিল্প, ব্যবসার কেন্দ্র।

পুরনো ভবনগুলো সংস্কার করে তৈরি করা হয় আধুনিক সব স্থাপনা। এর মধ্যে অন্যতম হলো মিশিগান সেন্ট্রাল স্টেশন, যা একসময় ছিল শহরের ধ্বংসের প্রতীক, বর্তমানে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয়ে সংস্কার করা হয়েছে।

ডেট্রয়েটের নদীর তীর ধরে তৈরি হয়েছে নতুন পার্ক, সাইকেল চালানোর পথ।

শিল্পকলার প্রতি ডেট্রয়েটের মানুষের ভালোবাসা সবসময় ছিল। এক সময়ের অবহেলিত শহরটিতে এখন গড়ে উঠেছে অসংখ্য আর্ট গ্যালারি, জাদুঘর আর সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।

ডেট্রয়েট ইনস্টিটিউট অফ আর্টস-এর মতো বিখ্যাত গ্যালারিগুলোতে ভিড় করেন শিল্পপ্রেমীরা। স্থানীয় উদ্যোক্তা, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন ফাউন্ডেশন এই পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

শহরের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ আফ্রিকান-আমেরিকান, এবং এই পরিবর্তনের ফলে তাদের জীবনযাত্রায়ও ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

ডেট্রয়েটের এই পরিবর্তনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে সেখানকার মানুষ। স্থানীয় শিল্পী, উদ্যোক্তা এবং বাসিন্দারা শহরটিকে নতুন রূপে সাজানোর জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের সৃজনশীলতা আর কঠোর পরিশ্রমের ফলে ডেট্রয়েট আজ নতুন করে জেগে উঠেছে।

ডেট্রয়েটের এই পরিবর্তনে যারা যেতে চান, তাদের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থান:

  • মোটাউন মিউজিয়াম: ১৯৬০-এর দশকে, ডেট্রয়েট ‘মোটর টাউন’ নামে পরিচিত ছিল। এই শহরেই জন্ম নিয়েছিল ‘মোটাউন’ মিউজিক, যা ছিল এক নতুন ধারার সঙ্গীতের জন্মস্থান। এই জাদুঘরে রয়েছে বিখ্যাত শিল্পী সুপ্রিমস এবং স্টিভি ওয়ান্ডারের গান রেকর্ড করার স্টুডিও ‘এ’।
  • ডেট্রয়েট ইনস্টিটিউট অফ আর্টস: এখানে রদ্যাঁর ‘দ্য থিঙ্কার’-এর মতো বিখ্যাত ভাস্কর্য ছাড়াও মোনে, মাতিস এবং সমসাময়িক আফ্রিকান-আমেরিকান শিল্পীদের মাস্টারপিস রয়েছে।
  • ফোর্ড পಿಕೆট অ্যাভিনিউ প্ল্যান্ট: এই ঐতিহাসিক কারখানাতেই হেনরি ফোর্ড প্রথম ‘মডেল টি’ গাড়ি তৈরি করেন, যা গাড়ির জগতে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে।
  • হেনরি ফোর্ড মিউজিয়াম: এখানে আমেরিকান উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তির অগ্রগতির ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে।

এছাড়াও, কেনাকাটার জন্য ওয়েস্ট ক্যানফিল্ড স্ট্রিট এবং এভিনিউ অফ ফ্যাশনের মতো জায়গাগুলো খুবই জনপ্রিয়। স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হতে চাইলে, শুক্রবার রাতে ডেট্রয়েট ইনস্টিটিউট অফ আর্টস-এ লাইভ মিউজিক উপভোগ করা যেতে পারে।

ডেট্রয়েটের নিজস্ব ‘ডিট্রয়েট-স্টাইল পিৎজা’র স্বাদ নিতে পারেন।

ডেট্রয়েটের এই ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক। যেকোনো শহরের উত্থান-পতন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।

তবে, ডেট্রয়েটের মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর এই অদম্য ক্ষমতা, তাদের সংস্কৃতিপ্রেম এবং উদ্ভাবনী চিন্তা আমাদের অনেক কিছু শেখায়। বাংলাদেশের শহরগুলোতেও ডেট্রয়েটের এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে উন্নয়নমূলক কাজ করা যেতে পারে।

তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *