গাজায় যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা: কয়েক মাসের মধ্যে সবচেয়ে কাছাকাছি
ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনা আবারও গতি পেয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও এই বিষয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন।
হামাস জানিয়েছে, তারা ইসরায়েলের সঙ্গে ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির একটি প্রস্তাবের ‘ইতিবাচক জবাব’ দিয়েছে। খবর অনুযায়ী, আগামী সপ্তাহেই এই বিষয়ে একটি চুক্তি হতে পারে।
দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধ ছিল, যার কারণে আলোচনা ভেস্তে যাচ্ছিল। তবে এবার উভয় পক্ষই প্রস্তাবিত পরিবর্তনে রাজি হওয়ায় সমঝোতা অনেকটাই কাছাকাছি বলে মনে করা হচ্ছে।
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর নতুন করে এই আলোচনা শুরু হয়েছে। এছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক চাপও এর পেছনে কাজ করেছে।
যুদ্ধবিরতির কারণ কি?
গত ২৪শে জুন ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়। এরপর কাতার ও মিশর উভয় দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায়।
কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সিএনএনকে জানান, ইরান-ইসরায়েল চুক্তির ফলে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে নতুন আলোচনার পথ তৈরি হয়েছে।
গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি হামলার কারণে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। ইসরায়েল মার্চ মাস থেকে গাজায় মানবিক সহায়তা পাঠানো বন্ধ করে দেয়।
পরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনার মুখে মে মাসে অবরোধ কিছুটা শিথিল করা হয়।
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ইসরায়েলি হামলায় গাজায় শত শত ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। খাদ্য বিতরণের সময়ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, যেখানে গাজা মানবিক ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) থেকে খাদ্য সংগ্রহের সময় অনেকে নিহত হয়েছে।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের অভ্যন্তরেও প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ওপর চাপ বাড়ছে। তাঁর সরকার চরমপন্থী রাজনীতিবিদদের সমর্থনপুষ্ট, যারা গাজায় যুদ্ধ চালিয়ে যেতে আগ্রহী।
তবে বিরোধীদলীয় নেতা ইয়ার লাপিদ জানিয়েছেন, জিম্মি উদ্ধারের জন্য তিনি কোয়ালিশন সরকারে যোগ দিতে প্রস্তুত। জনমত জরিপে দেখা গেছে, অধিকাংশ ইসরায়েলি নাগরিক যুদ্ধ বন্ধ করে জিম্মিদের ফিরিয়ে আনতে চান।
ইসরায়েলের প্রধান দাবিগুলো কি?
জিম্মিদের ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি নেতানিয়াহুর মূল লক্ষ্য হল গাজাকে নিরস্ত্র করা এবং হামাসের সামরিক শক্তি ও প্রশাসনিক ক্ষমতা ধ্বংস করা।
তবে সম্প্রতি তিনি ইসরায়েলের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে হামাসকে পরাজিত করার পরিবর্তে জিম্মিদের ফিরিয়ে আনার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। নেতানিয়াহু বলেছেন, ইরানের সামরিক অভিযানের পর “অনেক সুযোগ তৈরি হয়েছে”, যার মধ্যে জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা অন্যতম।
অন্যদিকে, হামাসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করতে চায় এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে মানবিক সহায়তা চায়।
এছাড়া, তারা চাইছে ইসরায়েল যেন গত ২ মার্চের আগের অবস্থানে ফিরে যায়, যখন তারা গাজার উত্তরাংশ দখল করে নেয়।
হামাসের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা সিএনএনকে জানিয়েছেন, তারা “এক দিনের মধ্যে জিম্মিদের ফেরত দিতে প্রস্তুত”, তবে তাদের নিশ্চয়তা দিতে হবে যে এরপর আর যুদ্ধ হবে না।
প্রস্তাবিত চুক্তিতে কি আছে?
যদিও বিস্তারিত এখনো প্রকাশ করা হয়নি, তবে জানা গেছে, এই প্রস্তাবে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে কিছু বিষয় মীমাংসার চেষ্টা করা হয়েছে।
আলোচনা সূত্রে জানা যায়, প্রস্তাব অনুযায়ী, ৬০ দিনের মধ্যে জীবিত ১০ জন ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হবে। বিনিময়ে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের কতজন বন্দীকে মুক্তি দেবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়।
বর্তমানে গাজায় আটকে থাকা প্রায় ৫০ জন জিম্মির মধ্যে অন্তত ২০ জন জীবিত আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চুক্তি অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতির প্রথম দিনেই হামাস আটজন জীবিত জিম্মিকে মুক্তি দেবে। এর বিনিময়ে ইসরায়েল গাজার কিছু এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে এবং ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি দেবে।
আলোচনা সূত্রে আরও জানা যায়, প্রাথমিক যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির আলোচনা শুরু হবে।
জিম্মিদের মুক্তি দেওয়ার সময় কোনো আনুষ্ঠানিকতা বা প্রচার করা হবে না। এর আগে হামাস জিম্মিদের মুক্তির সময় যে প্রচার চালিয়েছিল, তা নিয়ে ইসরায়েলে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল।
যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জাতিসংঘসহ অন্যান্য সংস্থাগুলো গাজায় মানবিক সহায়তা পাঠানো শুরু করবে।
আলোচনা এখনো বাকি
যদিও উভয় পক্ষই প্রস্তাব মেনে নিয়েছে, তবে যুদ্ধবিরতি শুরুর আগে আরও কিছু বিষয়ে আলোচনা করতে হবে। সম্ভবত কায়রো অথবা দোহায় এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে।
আলোচনায় ইসরায়েলি বাহিনীর গাজা থেকে সেনা সরানোর সময়সীমা ও স্থান নির্ধারণ করা হবে।
আগের যুদ্ধবিরতিগুলো কতদিন স্থায়ী হয়েছিল?
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে গত ২১ মাসের যুদ্ধে মোট ৯ সপ্তাহ যুদ্ধবিরতি ছিল। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গাজায় এখন পর্যন্ত ১৭,০০০ জনের বেশি শিশুসহ ৫৭,০০০ এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।
২০২৩ সালের নভেম্বরে প্রথম যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়, যা এক সপ্তাহ স্থায়ী হয়েছিল। ওই সময়ে ১০৫ জন জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং এর বিনিময়ে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের অনেক বন্দীকে মুক্তি দেয়।
দ্বিতীয় যুদ্ধবিরতি হয় ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে, যা প্রায় আট সপ্তাহ চলেছিল। হামাস ৩৩ জন জিম্মিকে মুক্তি দেয় এবং ইসরায়েল এর বিনিময়ে প্রায় ১৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেয়।
তবে, ইসরায়েল জানায়, হামাস অবশিষ্ট জিম্মিদের মুক্তি দিতে রাজি না হওয়ায় তারা যুদ্ধবিরতি ভেঙে দেয়।
তথ্য সূত্র: সিএনএন