একসময় ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (VR)-এর ধারণা বিনোদন জগতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে মনে করা হয়েছিল। বহু বছর আগে, যখন প্রথম ভার্চুয়াল রিয়েলিটি হেডসেট, ওকুলাস রিফট (Oculus Rift) বাজারে আসে, তখন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা এমনটাই আশা করেছিলেন।
কিন্তু সেই প্রত্যাশা পূরণ হতে যেন দেরি হচ্ছিল। যদিও প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে ভিআর প্রযুক্তি উন্নত হয়েছে, তবুও একে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াটা কঠিন ছিল।
তবে, সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা আবারও সেই সম্ভবনা জাগিয়ে তুলেছে। মেটা (Meta) এবং অ্যাপলের (Apple)-এর মতো বৃহৎ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো এখন ভিআর এবং অগমেন্টেড রিয়েলিটি (AR) নিয়ে নতুন করে কাজ শুরু করেছে।
জানা যাচ্ছে, মেটা তাদের কোয়েস্ট (Quest) ভিআর হেডসেটের জন্য আকর্ষণীয় কনটেন্ট তৈরি করতে ডিজনি (Disney), এটুয়েন্টিফোর (A24)-এর মতো বিনোদন সংস্থাগুলির সাথে আলোচনা করছে। অন্যদিকে, অ্যাপল তাদের ভিশন প্রো (Vision Pro) হেডসেটের নতুন সংস্করণ ঘোষণা করেছে, যেখানে ব্যবহারকারীরা অন্যদের সাথে কন্টেন্ট শেয়ার করতে পারবে, যা সিনেমা উপভোগের অভিজ্ঞতা আরও উন্নত করবে।
শুধু তাই নয়, অ্যাপল তাদের ভিআর প্ল্যাটফর্মে মেটালিকার কনসার্টও নিয়ে এসেছে।
এই সমস্ত পদক্ষেপ প্রমাণ করে যে, প্রযুক্তি এবং মিডিয়া জায়ান্টরা এখনও বিশ্বাস করে, সাধারণ মানুষ হয়তো শীঘ্রই ঐতিহ্যবাহী স্ক্রিনের বাইরে কনসার্ট, সিনেমা এবং খেলাধুলার মতো অভিজ্ঞতা উপভোগ করতে হাজার হাজার টাকা খরচ করতে প্রস্তুত হবে।
কিন্তু এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন থেকে যায় – এই ভিআর প্রযুক্তি কি সত্যিই ব্যবহারকারীদের জন্য যথেষ্ট আকর্ষণীয়? ওকুলাস রিফটের (Oculus Rift) আবির্ভাবের দশ বছর পরেও, হেডসেট প্রস্তুতকারকরা আরও হালকা ও শক্তিশালী ডিভাইস তৈরি করেছে।
অন্যদিকে, বিনোদন সংস্থাগুলোও গল্প বলার জন্য নতুন মাধ্যম হিসেবে ভিআর-এর সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে চাইছে। মেটা সম্প্রতি ভার্চুয়ালি স্ট্যানলি কাপ (Stanley Cup) গেমসের টিকিট বিক্রি করেছে, যা আগে এনবিএ (NBA) এবং ডব্লিউএনবিএ (WNBA)-এর ক্ষেত্রেও দেখা গেছে।
এমনকি, অ্যাপলের (Apple) তৈরি করা একটি ইমারসিভ (immersive) আলিশিয়া কিসের কনসার্ট এবং মেটার ব্ল্যাকপিঙ্ক শো-এর মতো ঘটনাগুলোও ভিআর-এর জনপ্রিয়তা বাড়াতে সহায়ক হয়েছে।
তবে, এই ধরনের উদ্যোগগুলো এখনো পর্যন্ত আগ্রহ যাচাইয়ের পর্যায়েই সীমাবদ্ধ। মূল সমস্যা হলো, ভিআর-এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য দরকার আকর্ষণীয় কন্টেন্ট, আবার সেই কন্টেন্ট তৈরি করার জন্য প্রয়োজন ব্যাপক ব্যবহারকারী।
প্রযুক্তিকে অবশ্যই আরামদায়ক, শক্তিশালী এবং জনপ্রিয় হতে হবে, যাতে এটি সহজে মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে। মেটার (Meta) ভিআর বিভাগের বিনোদন কন্টেন্ট ডিরেক্টর সারা মালকিন মনে করেন, এই চক্রটি ভাঙতে শুরু করেছে।
তিনি সিএনএনকে (CNN) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমার মনে হয়, যখন আপনি আপনার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে নিয়মিতভাবে মিশ্র বাস্তবতার অভিজ্ঞতা লাভ করবেন, তখনই সাফল্যের আসল মুহূর্ত আসবে। আমার মতে, সেই প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
বাজার গবেষণা সংস্থা আইডিসি (IDC)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে অগমেন্টেড রিয়েলিটি (AR) এবং ভিআর (VR) হেডসেটের বিশ্বব্যাপী শিপমেন্ট প্রায় ১০ শতাংশ বেড়ে ৭.৫ মিলিয়নে পৌঁছেছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই এই বৃদ্ধি ছিল প্রায় ৩০.৮ শতাংশ, যা প্রায় ৩.৪ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে।
যদিও আইডিসি-র পূর্বাভাস অনুযায়ী, এই বছর বাজারে নতুন পণ্য আসতে দেরি হওয়ায় বিশ্বব্যাপী শিপমেন্ট কিছুটা কমতে পারে, তবে ২০২৬ সালে এটি ৯৮.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১১.৩ মিলিয়নে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তবে, সব সাফল্যের গল্পে যেমন উত্থান-পতন থাকে, এক্ষেত্রেও তেমনটা দেখা গেছে। উদাহরণস্বরূপ, মার্ক জাকারবার্গের (Mark Zuckerberg) মেটাভার্স (Metaverse) তৈরিতে মেটার (Meta) গত তিন বছরে প্রায় ৪৬ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে।
একই সময়ে, ভিআর বিভাগ, রিয়েলিটি ল্যাবস (Reality Labs) প্রথম প্রান্তিকে ৪.২ বিলিয়ন ডলার পরিচালন লোকসান এবং মাত্র ৪১২ মিলিয়ন ডলারের বিক্রি দেখিয়েছে, যা আগের প্রান্তিকের তুলনায় কম।
তবে প্রযুক্তি জায়ান্টরা এই প্রযুক্তি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। ব্লুমবার্গের (Bloomberg) খবর অনুযায়ী, মেটা তাদের এআই চশমার (AI spectacle) জন্য এসিলাক্সোটিিকা এসএ (EssilorLuxottica SA) নামক একটি চশমা প্রস্তুতকারক সংস্থায় ৩.৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।
স্ন্যাপ (Snap) আগামী বছর নতুন অগমেন্টেড রিয়েলিটি চশমা (augmented reality spectacles) চালু করার পরিকল্পনা করছে। গুগল (Google) তাদের নতুন অ্যান্ড্রয়েড এক্সআর (Android XR) সফটওয়্যারের (software) জন্য এক্সরিয়াল (Xreal) এবং স্যামসাং-এর (Samsung) মতো অংশীদারদের সাথে কাজ করছে।
স্যামসাং তাদের আসন্ন প্রজেক্ট মুহান (Project Moohan) হেডসেট নিয়ে কাজ শুরু করেছে এবং খুব শীঘ্রই এই ধরনের ডিভাইস বাজারে আসবে।
ভিআর প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের জন্য উন্নত হার্ডওয়্যার এবং আকর্ষণীয় কন্টেন্ট জরুরি বলে মনে করেন টিপটিক ক্যাপিটালের (Triptyq Capital) অংশীদার ও সাবেক ভিশন প্রো-এর (Vision Pro) কন্ট্রিবিউটর বেরট্রান্ড নেপভিউ।
তিনি সিএনএনকে (CNN) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও, প্রযুক্তিগত কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। আমাদের আরও বেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন, কারণ এর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ জনসমষ্টি দরকার।
বর্তমানে, জেমস ক্যামেরন (James Cameron) এবং সাবরিনা কার্পেন্টারের (Sabrina Carpenter)-এর মতো বড় ব্যক্তিত্বরা ভিআর নিয়ে কাজ শুরু করলেও, এখনো পর্যন্ত এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়নি।
এর কারণ হিসেবে স্টুডিওগুলোর কিছু ভুল ধারণা চিহ্নিত করা যায়। ইন্ডাস্ট্রির পরামর্শদাতা জেনা সেইডেন সিএনএনকে (CNN) বলেন, “আপনি কেবল ডিজনি+ (Disney+) বা নেটফ্লিক্স (Netflix) বা অ্যামাজনে (Amazon) যা দেখছেন, তা সরাসরি এখানে ব্যবহার করতে পারবেন না।
প্রতিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য আলাদাভাবে তৈরি করতে হবে, যাতে দর্শকদের অভিজ্ঞতা ভিন্ন হয়।
ভিআর এবং মিশ্র বাস্তবতার জন্য মিডিয়া তৈরি করা টু-ডি স্ক্রিনের জন্য কন্টেন্ট তৈরি করা থেকে ভিন্ন হতে পারে।
তবে, সেইডেন মনে করেন, সাফল্যের চাবিকাঠি হলো একচেটিয়া কন্টেন্ট, যা মিডিয়া কোম্পানিগুলো আগে থেকেই করে আসছে।
তিনি উদাহরণস্বরূপ এইচবিও ম্যাক্স (HBO Max) এবং অ্যাপল টিভি প্লাসকে (Apple TV+) তুলে ধরেন, যারা তাদের একচেটিয়া কন্টেন্টের মাধ্যমে দর্শক তৈরি করেছে।
লাইভ ভার্চুয়াল স্পোর্টস (live virtual sports) দর্শকদের জন্য এক্সটেন্ডেড রিয়েলিটি (extended reality) ব্যবহার করার একটি সহজ উপায় হতে পারে।
ফেলিক্স অ্যান্ড পলের (Felix & Paul) সহ-প্রতিষ্ঠাতা পল রাফায়েল বলেন, খেলাধুলা ১৮০-ডিগ্রি ক্যামেরা ব্যবহার করে সহজেই ইমারসিভ প্ল্যাটফর্মের জন্য তৈরি করা যেতে পারে।
হলিউডের জন্য, একটি নতুন, প্রধান বিতরণ প্ল্যাটফর্মের সম্ভাবনা এই মুহূর্তে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
স্ট্রিমিং, কেবল টিভির (cable tv) বিলুপ্তি এবং কোভিড-পরবর্তী বক্স অফিসের (box office) খারাপ অবস্থার কারণে মিডিয়া জগতে যে পরিবর্তন এসেছে, তাতে নতুন একটি মাধ্যম বিনোদন সংস্থাগুলোর জন্য আয়ের নতুন পথ খুলে দিতে পারে।
ক্রিপ্টটিভি’র (CryptTV) সহ-প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক ডেভিস (Jack Davis) মনে করেন, হেডসেটগুলো প্রিমিয়াম কন্টেন্টের জন্য একটি প্রয়োজনীয় মাধ্যম হতে পারে।
তবে, এই প্রযুক্তির বিকাশে অর্থ বিনিয়োগ করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। গত এক দশকে, ভিআর-এর (VR) চেয়ে স্ব-চালিত গাড়ি (self-driving cars) এবং এআই-এর (AI)-এর মতো উদ্ভাবনে বেশি বিনিয়োগ হয়েছে।
ক্রাঞ্চবেসের (Crunchbase) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে এআই এবং স্ব-চালিত প্রযুক্তিতে ৩৯.৯৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছিল, যা ২০২৫ সাল নাগাদ ১০৫.৩৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
একই সময়ে, ভিআর খাতে বিনিয়োগের চিত্র ছিল বেশ অস্থির।
২০২১ সালে এখানে ৪.০৮৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হলেও, ২০২৫ সাল নাগাদ তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৪৫.৬৯ মিলিয়ন ডলারে।
তবে, নেপভিউ (Nepveu) মনে করেন, পরিস্থিতি বদলাচ্ছে।
তিনি বলেন, “এখন যেহেতু এআই সম্পর্কে মানুষের ধারণা আরও স্পষ্ট হয়েছে, তাই ভিআর খাতে পুনরায় বিনিয়োগ বাড়ছে।
বর্তমানে, প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো মিশ্র বাস্তবতার হেডসেট (mixed reality headsets) তৈরি করতে গিয়ে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে।
তাদের একদিকে যেমন আকর্ষণীয় বিনোদন সরবরাহ করতে হবে, তেমনই ব্যবহারকারীদের এই ডিভাইস কেনার এবং ব্যবহারের জন্য রাজি করাতে হবে।
অ্যাপল (Apple) সম্ভবত এই কারণে ভিশন প্রোকে (Vision Pro) একটি স্থানিক কম্পিউটিং টুল (spatial computing tool) হিসেবে তুলে ধরেছে, যা শুধুমাত্র টু-ডি এবং থ্রি-ডি বিনোদনের (2-D and 3-D entertainment) পরিবর্তে কাজ ও উৎপাদনশীলতার ওপর বেশি জোর দেয়।
বিশেষজ্ঞরা একমত হতে পারছেন না যে, ঠিক কবে ভিআর-এর (VR) আসল সাফল্য আসবে।
নেপভিউ মনে করেন, এটি যে কোনো দিন হতে পারে। রাফায়েলের মতে, এক বা দুই বছরের মধ্যে এই পরিবর্তন আসবে।
ডেভিস (Davis) ধারণা করছেন, তিন থেকে সাত বছরের মধ্যে ভিআর জনপ্রিয়তা পাবে। সেইডেন (Seiden)-এর মতে, এই সময় পাঁচ থেকে দশ বছর পর্যন্ত লাগতে পারে।
তবে, রাফায়েল মনে করেন, টু-ডি কন্টেন্ট (2-D content) খুব শীঘ্রই ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট (black and white) সিনেমার মতো পুরনো হয়ে যাবে।
তাঁর মতে, “আজকের দিনে যেভাবে কন্টেন্ট উপভোগ করা হয়, তাতে যদি কোনো ফিল্ম ইমারসিভ (immersive) না হয়, তবে এটি তার মূল্য হারাবে না, তবে অন্য যুগের একটি বিষয় হিসেবে বিবেচিত হবে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন (CNN)