ব্যাঙ: প্রকৃতির এক বিস্ময়কর প্রাণী
ছোট্ট একটি প্রাণী, কিন্তু তাদের ক্ষমতাগুলো শুনলে অবাক হতে হয়। এরা প্রকৃতির সবচেয়ে অভিযোজনযোগ্য এবং বিস্ময়কর প্রাণীগুলোর মধ্যে অন্যতম।
এদের কেউ চামড়ার মাধ্যমে শ্বাস নেয়, কেউ রঙ বদলাতে পারে, আবার কেউ হিমাঙ্কের নিচেও টিকে থাকতে পারে। আজকের লেখায় আমরা ব্যাঙ সম্পর্কে এমনই কিছু মজাদার তথ্য জানবো, যা হয়তো আগে শোনেননি!
ত্বকের মাধ্যমে শ্বাস ও জল গ্রহণ
ব্যাঙেরা তাদের ত্বক দিয়ে শ্বাস নেয় এবং জল শোষণ করে। তাদের ত্বকের একটি বিশেষ অংশ রয়েছে, যা “পান করার প্যাচ” নামে পরিচিত।
এই প্যাচটি তাদের পেটে বা পায়ে থাকে। এই বিশেষত্ব তাদের আর্দ্র পরিবেশে জল পান করা এবং সতেজ থাকতে সাহায্য করে।
এছাড়াও, তাদের ত্বক গ্যাস আদান প্রদানেও সহায়তা করে, যার ফলে তারা জলের নিচে বা আর্দ্র বাতাসে শ্বাস নিতে পারে। তবে, দূষিত পরিবেশে এটি তাদের জন্য ক্ষতির কারণও হতে পারে, কারণ রাসায়নিক পদার্থও তাদের ত্বক সহজে শোষণ করতে পারে।
রঙ বদলানোর ক্ষমতা
কিছু ব্যাঙ তাদের চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে বা নিজেদের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এমনকি সামাজিক সংকেত পাঠানোর জন্যও তারা রঙ পরিবর্তন করে।
এই ক্ষমতা তাদের ত্বকের বিশেষ কোষ, ক্রোমাটোফোর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, যা বিভিন্ন পিগমেন্ট প্রদর্শন করতে প্রসারিত বা সংকুচিত হতে পারে।
আর্দ্রতা, আলো এবং চাপের মতো পরিবেশগত কারণগুলো এই পরিবর্তনে প্রভাব ফেলে।
উদাহরণস্বরূপ, শীতল আবহাওয়ায় উষ্ণ হওয়ার জন্য একটি ব্যাঙ গাঢ় হতে পারে বা শিকারী প্রাণী থেকে বাঁচতে গাছের বাকলের সাথে মিশে যেতে পারে।
প্রজনন মৌসুমে কিছু প্রজাতির পুরুষ ব্যাঙ স্ত্রী ব্যাঙকে আকৃষ্ট করার জন্য তাদের রঙ উজ্জ্বল করে।
জোর আওয়াজের রহস্য
ব্যাঙের ডাক এত জোরালো হওয়ার কারণ হল তাদের বিশেষ ভোকাল থলি। এই থলিগুলো প্রসারিত হয়ে শব্দকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
এর ফলে ব্যাঙকে বেশি শক্তি খরচ না করে শব্দ অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারে।
বিভিন্ন প্রজাতির ব্যাঙের ভোকাল থলির আকার ভিন্ন হতে পারে, যা তাদের কণ্ঠস্বরের স্বর এবং ভলিউমের উপর প্রভাব ফেলে।
ব্যাঙেরা তাদের ডাক ব্যবহার করে সঙ্গীকে আকৃষ্ট করতে, নিজেদের এলাকা রক্ষা করতে অথবা বিপদের সংকেত দিতে, এমনকি কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে নিজেদের আওয়াজ স্পষ্ট রাখতেও এই থলির ব্যবহার করে।
হিমাঙ্কের নিচেও বাঁচার কৌশল
উড ব্যাঙ (Wood frogs) শীতকালে হিমাঙ্কের নিচেও টিকে থাকতে পারে।
তারা বিশেষ ধরনের অ্যান্টিফ্রিজ (গ্লুকোজ এবং ইউরিয়া) তৈরি করে, যা তাদের কোষগুলোকে জমাট বাঁধা থেকে রক্ষা করে।
এই অবস্থায় ব্যাঙের হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়, শ্বাস-প্রশ্বাসও থেমে যায়।
কিন্তু তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে তারা আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে।
বিজ্ঞানীরা এই ধরনের ব্যাঙ নিয়ে গবেষণা করেন এবং তাদের এই বৈশিষ্ট্য থেকে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য টিস্যু সংরক্ষণে সাহায্য পেতে পারেন।
খাবার গেলার অভিনব কায়দা
ব্যাঙের চোখের পাতা আমাদের চোখের মতো নয়। তাদের চোখ বাইরের দিকে প্রসারিত থাকে, যা তাদের প্রায় ১৮০-ডিগ্রি পর্যন্ত দেখতে সাহায্য করে।
খাবার খাওয়ার সময়, ব্যাঙ তার জিভ দিয়ে শিকারকে মুখের ভেতর নিয়ে আসে এবং চোখের পাতা বন্ধ করে চোখগুলোকে মুখের উপরের দিকে চেপে ধরে, যা খাবার গলাধঃকরণে সাহায্য করে।
বাচ্চাদের প্রতি যত্ন
কিছু ব্যাঙ তাদের ডিম এবং বাচ্চাদের বিশেষ উপায়ে রক্ষা করে।
উদাহরণস্বরূপ, মিডওয়াইফ টোড (Midwife toad) পুরুষেরা তাদের পিঠে বা পায়ে ডিম বহন করে এবং বাচ্চা ফুটে না আসা পর্যন্ত তাদের দেখাশোনা করে।
আবার গ্যাস্ট্রোথেকা (Gastrotheca) প্রজাতির স্ত্রী ব্যাঙ তাদের পেটের ভেতরে ডিম বহন করে এবং সরাসরি বাচ্চা প্রসব করে।
এই কৌশলগুলো তাদের শিকারী, খরা বা প্রতিকূল পরিবেশ থেকে অতিরিক্ত সুরক্ষা দেয়।
ক্ষুদ্রতম ব্যাঙ
পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম ব্যাঙ হল নিউ গিনি অ্যামাউ ব্যাঙ (New Guinea Amau frog), যার বৈজ্ঞানিক নাম Paedophryne amauensis।
এটি মাত্র ০.৩ ইঞ্চি (৭.৭ মিলিমিটার) লম্বা হয়।
এই ক্ষুদ্রাকৃতির ব্যাঙটি সাধারণ একটি মাছি বা ছোট একটি বাংলাদেশি মুদ্রার থেকেও ছোট।
তারা পাতা ও আবর্জনার মধ্যে বাস করে এবং খুব ছোট পোকামাকড় খেয়ে জীবন ধারণ করে।
আকারে ছোট হলেও, তাদের জীবনযাত্রা বেশ জটিল এবং তাদের শরীরের সব অঙ্গ বিদ্যমান।
উচ্চতা জয় করার কৌশল
গাছে বসবাসকারী অনেক ব্যাঙের পায়ে আঠালো প্যাড থাকে, যা তাদের পাতা, গাছের বাকল বা কাঁচের মতো স্থানেও আটকে থাকতে সাহায্য করে।
এই প্যাডগুলোতে অসংখ্য ক্ষুদ্র খাঁজ এবং শ্লেষ্মা (mucus) থাকে, যা তাদের সহজে উপরে উঠতে এবং স্থিতিশীল থাকতে সহায়তা করে।
বিভিন্ন শব্দের তাৎপর্য
প্রতিটি প্রজাতির ব্যাঙের নিজস্ব স্বতন্ত্র শব্দ রয়েছে।
কিছু দ্রুত এবং তীক্ষ্ণ শব্দ করে, আবার কিছু ধীরে এবং গভীর শব্দ করে।
পুরুষ ব্যাঙ সঙ্গীকে আকৃষ্ট করার জন্য এই শব্দ ব্যবহার করে।
তারা তাদের এলাকা রক্ষার জন্য এবং বিপদ সংকেত হিসেবেও শব্দ ব্যবহার করে।
কিছু প্রজাতি তাদের প্রতিবেশীদের চিনতে পারে এবং অপরিচিতদের প্রতি ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখায়, যা তাদের সামাজিক সচেতনতা প্রমাণ করে।
শত্রুদের বোকা বানানোর কৌশল
প্রায় সব ব্যাঙেরই চামড়ার বিশেষ রঙ এবং নকশা থাকে, যা তাদের চারপাশের পরিবেশের সাথে মিশে যেতে সাহায্য করে।
এর ফলে তারা শিকারী এবং শিকার উভয় থেকেই নিজেদের আড়াল করতে পারে।
কিছু ব্যাঙ, যেমন গাছের ব্যাঙ, তাদের শরীরকে সমতল করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্থির থাকতে পারে, যা তাদের ছদ্মবেশ ধারণে সাহায্য করে।
বিষাক্ত ব্যাঙের সতর্কতা
কিছু ব্যাঙ আত্মরক্ষার জন্য ত্বকের বিষ ব্যবহার করে, যা শিকারীদের জন্য মারাত্মক হতে পারে।
বিষাক্ত ডার্ট ব্যাঙ (Poison dart frogs) তাদের উজ্জ্বল রঙের জন্য পরিচিত, যা লাল, নীল এবং হলুদ সহ বিভিন্ন রঙে দেখা যায়।
এই রঙগুলো তাদের সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করে।
বিস্ময়কর লাফ
বেশিরভাগ ব্যাঙ তাদের শরীরের দৈর্ঘ্যের চেয়ে ২০ গুণের বেশি লাফ দিতে পারে।
তাদের শক্তিশালী পায়ের পেশী এবং স্প্রিং-এর মতো টেন্ডন (tendon) থাকার কারণে এটি সম্ভব।
তৃতীয় চোখের পাতা
ব্যাঙের তৃতীয় চোখের পাতা বা নিকটিটেটিং মেমব্রেন (nictitating membrane) তাদের চোখকে রক্ষা করে।
এই পাতা চোখের উপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে চলে এবং তাদের জল বা কঠিন বস্তুকণা থেকে বাঁচায়।
স্বচ্ছ চামড়ার ব্যাঙ
সেন্ট্রাল ও দক্ষিণ আমেরিকায় পাওয়া যায় এমন কিছু গ্লাস ব্যাঙের (Glass frogs) চামড়া স্বচ্ছ হওয়ার কারণে তাদের ভেতরের অঙ্গ দেখা যায়।
তাদের পেটের মাধ্যমে হৃদপিণ্ড, যকৃত এবং অন্ত্র পর্যন্ত দেখা যায়।
নন-নিউটনীয় লালার কৌশল
ব্যাঙের লালা একটি বিশেষ ধরনের তরল, যা নন-নিউটনীয়।
এর অর্থ হল, এই তরলের সান্দ্রতা প্রয়োগ করা বলের পরিমাণের উপর নির্ভর করে।
যখন ব্যাঙ তাদের লম্বা জিভ ব্যবহার করে পোকামাকড় ধরে, তখন তাদের লালা আঠালো থাকে।
তারা যখন দ্রুত জিভকে ভেতরের দিকে টানে, তখন লালা শক্ত হয়ে আঠার মতো কাজ করে এবং পোকামাকড় আটকে যায়।
ব্যাঙ সম্পর্কে এই তথ্যগুলো জানার পর, তাদের প্রতি আপনার ভালো লাগা আরও বাড়বে।
তারা সত্যিই প্রকৃতির এক অসাধারণ সৃষ্টি!
তথ্যসূত্র: ট্রাভেল এন্ড লেজার।