জাতিসংঘে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান: ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকট নিরসনে কী? আর কী নয়?

জাতিসংঘে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকট নিরসনে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের পথে আলোচনার আহ্বান।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে (UN General Assembly) এই সপ্তাহে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দ্বন্দ্বে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের লক্ষ্যে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এর মূল উদ্দেশ্য হল, ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েলের দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা, যেখানে উভয় দেশের মানুষ শান্তি ও স্থিতিশীলতার সঙ্গে বসবাস করতে পারবে।

তবে, এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে ইসরায়েল ও তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র অংশ নিচ্ছে না। ফ্রান্স ও সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা যৌথভাবে এই বৈঠকের সভাপতিত্ব করছেন। ইসরায়েলের বর্তমান সরকার দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের ঘোর বিরোধী, আর যুক্তরাষ্ট্র মনে করে এই ধরনের বৈঠক গাজায় চলমান যুদ্ধ বন্ধের প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করবে। অন্যদিকে, ফ্রান্স ও সৌদি আরব মনে করে, দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানই এই অঞ্চলের শান্তি প্রতিষ্ঠার একমাত্র উপায়। তারা চায়, বৈঠকের মাধ্যমে কিভাবে এই লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়, তার একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা তৈরি করা হোক।

বৈঠকটি মূলত জুনের শেষে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ায়, বিশেষ করে ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের ১২ দিনের যুদ্ধ এবং গাজায় চলমান সংঘাতের কারণে এটি স্থগিত করা হয়।

ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যঁ-নয়েল বারোত সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে (CBS News’ “Face the Nation”) বলেছেন, “আজকের পরিস্থিতিতে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের বিষয়টি হুমকির সম্মুখীন, তাই এই রাজনৈতিক প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু করা অত্যন্ত জরুরি।

এখন প্রশ্ন হল, দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান আসলে কী?

ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে ভূমি বিভক্তির ধারণা বহু পুরোনো। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের পার্টিশন প্ল্যান অনুযায়ী, এই অঞ্চলকে দুটি ভাগে ভাগ করার কথা ছিল – একটি ইহুদি রাষ্ট্র ও অপরটি আরবদের জন্য। ইসরায়েল এই পরিকল্পনা মেনে নিলেও, তাদের প্রতিবেশী আরব দেশগুলো এর বিরোধিতা করে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়, ফলে পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হয়নি।

১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েল পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম ও গাজা উপত্যকা দখল করে নেয়। ফিলিস্তিনিরা তাদের ভবিষ্যৎ স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য এই ভূখণ্ডগুলো ফেরত চায়। তারা চায় ১৯৬৭ সালের আগের সীমানা অনুযায়ী একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হোক, যা দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।

আন্তর্জাতিক মহলে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের ধারণা ব্যাপক সমর্থন লাভ করেছে। এর মূল যুক্তি হল, ইসরায়েল, পূর্ব জেরুজালেম, পশ্চিম তীর ও গাজায় বসবাসকারী ইহুদি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে জনসংখ্যার বিভাজন প্রায় সমান। একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হলে, ইসরায়েল একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হবে, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ইহুদিরা বসবাস করবে এবং ফিলিস্তিনিরা তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ফিরে পাবে।

তাহলে, এখন কেন এই বৈঠক?

ফ্রান্স ও সৌদি আরবের মতে, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির একমাত্র পথ হল দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান। তারা চায়, এই আলোচনার মাধ্যমে একটি সুস্পষ্ট কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হোক, যার প্রথম পদক্ষেপ হবে গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করা। মে মাসে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোকে পাঠানো এক নথিতে বৈঠকের প্রধান লক্ষ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের জন্য “সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের” পদক্ষেপ চিহ্নিত করা এবং “নির্দিষ্ট ও সময়াবদ্ধ প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা ও সম্পদ সংগ্রহ করা।

সৌদি কূটনীতিক মানাল রাদওয়ান এই বৈঠকের প্রস্তুতিমূলক সম্মেলনে নেতৃত্ব দেন। তিনি বলেছেন, এই বৈঠক “আলোচনার পরিবর্তে কর্মপরিকল্পনার একটি ভিত্তি তৈরি করবে।” এটি অবশ্যই “সংঘাতের মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে শান্তি, মর্যাদা ও পারস্পরিক নিরাপত্তার বাস্তব পথ” তৈরি করবে।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের দিকে বৃহত্তর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি ঘোষণা করেছেন, আগামী সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বার্ষিক সম্মেলনে ফ্রান্স আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে। বর্তমানে প্রায় ১৪৫টি দেশ ফিলিস্তিনকে একটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

ইসরায়েলের অবস্থান কী?

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি জাতীয়তাবাদী ও নিরাপত্তা বিষয়ক কারণ উল্লেখ করেছেন। নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ভিত্তি মনে করে, পশ্চিম তীর হল ইহুদিদের ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় ভূমি, আর জেরুজালেমকে তারা তাদের চিরন্তন রাজধানী হিসেবে বিবেচনা করে।

নেতানিয়াহুর মতো কট্টরপন্থীরা মনে করেন, ফিলিস্তিনিরা শান্তি চায় না। তারা ২০০০ সালের দশকের শুরুর দিকে দ্বিতীয় ফিলিস্তিনি বিদ্রোহ এবং ২০০৫ সালে গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের পর হামাসের ক্ষমতা দখলের বিষয়টি উল্লেখ করেন। হামাসের ক্ষমতা দখলের ফলে পাঁচটি যুদ্ধ হয়, যার মধ্যে সর্বশেষ ২১ মাসের সংঘাতও অন্তর্ভুক্ত।

অন্যদিকে, ইসরায়েল এমন একটি সমাধানও চায় না, যেখানে ইহুদিরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে। নেতানিয়াহুর পছন্দ সম্ভবত বর্তমান পরিস্থিতি, যেখানে ইসরায়েলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে এবং ইসরায়েলিদের ফিলিস্তিনিদের চেয়ে বেশি অধিকার থাকবে। একইসঙ্গে, ইসরায়েল বসতি স্থাপন করে তাদের নিয়ন্ত্রণ আরও বাড়াতে পারবে, আর ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের পশ্চিম তীরের কিছু অংশে সীমিত স্বায়ত্তশাসন থাকবে।

ফিলিস্তিনের অবস্থান কী?

ফিলিস্তিনিরা বর্তমান পরিস্থিতিকে “বর্ণবৈষম্য” হিসেবে অভিহিত করে। তারা ইসরায়েলকে তাদের শান্তি প্রক্রিয়াকে দুর্বল করার জন্য পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন এবং সংযুক্তির হুমকি দেওয়ার অভিযোগ করে। তারা মনে করে, এর ফলে একটি অবিচ্ছিন্ন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং তাদের স্বাধীনতা অর্জনের পথ রুদ্ধ হবে।

ফিলিস্তিন মুক্তি ফ্রন্টের (PLO) নির্বাহী কমিটির সদস্য ও প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের ঘনিষ্ঠ সহযোগী আহমেদ মাজদালানি জানিয়েছেন, এই বৈঠক সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া একটি প্রেসিডেন্ট পর্যায়ের সম্মেলনের প্রস্তুতি হিসেবে কাজ করবে। জাতিসংঘে কর্মরত কূটনীতিকদের মতে, এই সম্মেলনটি সম্ভবত ফ্রান্স অথবা জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের পাশে অনুষ্ঠিত হবে।

ফিলিস্তিনিদের কয়েকটি প্রধান লক্ষ্য রয়েছে। তাদের প্রথম লক্ষ্য হল, “ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করা।” এছাড়াও, তারা ব্রিটেনসহ গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর কাছ থেকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য আরও বেশি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চায়। মাজদালানি আরও জানান, তারা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের জন্য অর্থনৈতিক ও আর্থিক সহায়তা এবং গাজা উপত্যকার পুনর্গঠন ও পুনরুদ্ধারের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন কামনা করেন।

বৈঠকে কী হতে পারে, আর কী হবে না?

বৈঠকে জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ফরাসি কূটনীতিকদের মতে, প্রায় ৪০ জন মন্ত্রী এতে অংশ নেবেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এতে অংশগ্রহণ করছে না।

বৈঠকের আয়োজকরা একটি প্রস্তাবিত ফলাফল নথি বিতরণ করেছেন, যা গৃহীত হতে পারে। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার কিছু ঘোষণা আসতে পারে। তবে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে, কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি বা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে দীর্ঘ-প্রতীক্ষিত আলোচনার পুনরুজ্জীবনের সম্ভাবনা নেই।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বৈঠকের শুরুতে অংশগ্রহণকারীদের প্রতি দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানকে “জীবিত রাখার” আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে শান্তি ও সহাবস্থানের সমাধানকে সমর্থন করতে হবে এবং “এটি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে।”

তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *