মার্কিন ভিসা জটিলতায় দিশেহারা ছাত্রছাত্রীরা, স্বপ্নভঙ্গ?

যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভিসা নিয়ে কড়াকড়ি আরোপ করায় অন্য দেশগুলোতে বাড়ছে শিক্ষার্থীর আগ্রহ। বিশেষ করে চীন থেকে আসা শিক্ষার্থীরা এখন বিকল্প গন্তব্য হিসেবে যুক্তরাজ্য, হংকং, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়ার মত দেশগুলোতে উচ্চ শিক্ষার জন্য ঝুঁকছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমনটাই উঠে এসেছে।

যুক্তরাষ্ট্র সরকার অভিবাসন নীতি কঠোর করার অংশ হিসেবে কলেজগুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা কমাতে চাপ সৃষ্টি করছে। এমনকি ফিলিস্তিনপন্থী কার্যক্রমে জড়িত থাকার অভিযোগে কিছু শিক্ষার্থীকে দেশ থেকে বিতাড়িত করারও চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া, সামান্য ভুলের কারণেও অনেক শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল করা হয়েছে। ভিসা প্রক্রিয়াকরণে কড়াকড়ি আরোপ করার ফলে অনেক শিক্ষার্থীই এখন যুক্তরাষ্ট্রে যেতে নিরুৎসাহিত হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় এখনো শীর্ষে থাকলেও, পরিস্থিতি পরিবর্তনের সুযোগ নিচ্ছে অন্যান্য দেশ। ফলে, অনেক শিক্ষার্থী এখন অন্য গন্তব্যের কথা ভাবছেন যা আগে হয়তো তাদের পছন্দের তালিকায় ছিল না। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে।

আন্তর্জাতিক শিক্ষা বিষয়ক সংস্থা NAFSA’র বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এই বছর যুক্তরাষ্ট্রে নতুন করে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। এর ফলে, যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে। কারণ, অনেক বিদেশি শিক্ষার্থী পুরো টিউশন ফি পরিশোধ করে থাকে, যা সরাসরি কলেজগুলোর আয়ে প্রভাব ফেলে।

এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে যুক্তরাজ্যের। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য দ্বিতীয় জনপ্রিয় গন্তব্য হওয়ায়, দেশটি সুবিধা পেতে পারে। যদিও যুক্তরাজ্যের নতুন সরকার অভিবাসন কমাতে চাইছে এবং পড়াশোনা শেষে কাজ করার জন্য ভিসার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে, তারপরও এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য এখনো বেশ আকর্ষণীয়। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার মত ইংরেজি প্রধান দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্যকে এখনো সবচেয়ে বেশি স্বাগত জানানোর মতো দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, গত বছর কমে যাওয়ার পর, এ বছর যুক্তরাজ্যে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামে ভর্তির জন্য বিদেশি শিক্ষার্থীদের আবেদন ২.২ শতাংশ বেড়েছে। চীন থেকে আসা শিক্ষার্থীদের আবেদনও রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি। এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা শিক্ষার্থীদের আবেদনও ১৪ শতাংশ বেড়ে প্রায় ৮,০০০-এ দাঁড়িয়েছে, যা গত ২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

ইউনিগেস্টের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যের স্নাতকোত্তর প্রোগ্রামে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ভর্তি প্রায় ১০ শতাংশ বেড়েছে। বিশেষ করে ব্যবসায় শিক্ষা এবং ব্যবস্থাপনার মতো বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বেশি দেখা যাচ্ছে।

ইলুম স্টুডেন্ট অ্যাডভাইজরি সার্ভিসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাইক হেনিংগার বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের ব্র্যান্ডের ওপর বড় ধরনের আঘাত লেগেছে এবং যুক্তরাজ্য এক্ষেত্রে সুবিধা পাচ্ছে।

এদিকে, চীনের শিক্ষার্থীদের মধ্যে হংকং, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনার আগ্রহ বাড়ছে। হংকংয়ের একটি পরামর্শক সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক উইল কওং জানান, পশ্চিমা বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস সেখানে রয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম খরচে পড়াশোনার সুযোগ করে দেয়।

কওং আরও বলেন, “কোভিড-১৯ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকেই এ অঞ্চলের দেশগুলোতে পড়াশোনার প্রবণতা বাড়ছে। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের নীতি পরিবর্তনের কারণে এটি আরও বেড়েছে।

চীন থেকে আসা আলিসা নামের একজন শিক্ষার্থী ডেটা সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করছেন। তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে অংশ নিতে চান। একইসঙ্গে, যুক্তরাষ্ট্রে মাস্টার্স করারও তার পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু ভিসা জটিলতার কারণে তিনি অন্যান্য বিকল্পও বিবেচনা করছেন।

হংকংয়ের প্রধান জন লি জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে যেতে না পারা শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানানো হবে। গত বছর, হংকং সরকার বিদেশি শিক্ষার্থীদের খণ্ডকালীন কাজের অনুমতি দেয়। হংকং ইউনিভার্সিটি জানিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা ৫০০ জনের বেশি শিক্ষার্থীর আবেদন পেয়েছে এবং প্রায় ২০০ জনের আবেদন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। হংকং ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতেও বিদেশি আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের আবেদন গত বছরের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেড়েছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশ বিদেশি শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে শাখা ক্যাম্পাস তৈরি করছে। দুবাই এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। এখানকার আমেরিকান একাডেমি ফর গার্লসের প্রধান শিক্ষিকা লিসা জনসন জানান, তার স্কুলের শিক্ষার্থীরা এখন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তে অন্য দেশের কলেজগুলোর দিকে ঝুঁকছে।

কাজাকিস্তানেরও একই ধরনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে। সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং রাশিয়া থেকে আসা শিক্ষার্থীদের আনাগোনা বাড়ছে।

তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *