মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমবাজারে কি মন্দা নামছে? এমন প্রশ্ন এখন অর্থনীতিবিদদের মনে। চলতি বছরের প্রথমার্ধে অর্থনীতির চাকচিক্য বজায় থাকলেও, এখন কর্মসংস্থান বৃদ্ধির গতি কমে আসার ঝুঁকি বাড়ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এমনটাই আভাস পাওয়া গেছে।
জুলাই মাসের কর্মসংস্থান বিষয়ক প্রতিবেদন অনুযায়ী, নতুন করে ১ লাখ ১৫ হাজার মানুষের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে, যা জুনের ১ লাখ ৪৭ হাজারের তুলনায় বেশ কম। ফ্যাক্টসেট-এর তথ্য অনুযায়ী, বেকারত্বের হার বেড়ে ৪.২ শতাংশে পৌঁছাতে পারে, যেখানে জুনে এই হার ছিল ৪.১ শতাংশ।
মার্কিন শ্রম পরিসংখ্যান ব্যুরোর (US Bureau of Labor Statistics) তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত প্রতি মাসে গড়ে ১ লাখ ২ হাজার থেকে ১ লাখ ৫৮ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এই সংখ্যাগুলোকে স্থিতিশীল হিসেবে ধরা হলেও, ২০২০ সালের মহামারী পরিস্থিতি বাদে, ২০১০ সালের পর এটিই হলো সবচেয়ে কম কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার।
নৌবাহিনী ফেডারেল ক্রেডিট ইউনিয়নের প্রধান অর্থনীতিবিদ হিদার লং-এর মতে, “আমরা এখন অর্থনীতির একটি ক্ষুদ্র অংশের ওপর কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। বাজারে কাজের সুযোগ কমে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) আসুক বা না আসুক, শুল্ক থাকুক বা না থাকুক, তেমন কোনো প্রভাব পড়ছে না।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নতুন কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে দ্বিধা বোধ করছে। এর প্রধান কারণ হলো, দেশটির বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে শুল্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা। এমন পরিস্থিতিতে কোম্পানিগুলো তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছে না, যে কারণে তারা কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে আরও তথ্য পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে।
এ ব্যাপারে নার্ডওয়্যালের (NerdWallet) সিনিয়র অর্থনীতিবিদ এলিজাবেথ রেন্টার বলেন, “বর্তমানে পরিস্থিতি এমন যে, প্রতি সপ্তাহেই অর্থনৈতিক পূর্বাভাস পরিবর্তিত হচ্ছে, যার ফলস্বরূপ কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা এক ধরনের অচলাবস্থায় রয়েছি।”
এদিকে, শ্রমিকদের মধ্যে চাকরি পরিবর্তনের প্রবণতা কমে যাওয়ায় শ্রমবাজারে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে, যা একটি সুস্থ অর্থনীতির জন্য প্রয়োজনীয়।
শ্রমবাজারের সর্বশেষ তথ্য বলছে, জুন মাসে কাজের সুযোগ কমেছে, নিয়োগের হার এক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে এবং কর্মীদের চাকরি ছাড়ার হারও গত পাঁচ বছরের গড় থেকে কম।
যদিও বিভিন্ন প্রতিবেদনে কর্মী ছাঁটাইয়ের সংখ্যা বাড়ছে দেখা যাচ্ছে, তবে এর কারণ হিসেবে মূলত ফেডারেল সংস্থাগুলোতে ট্রাম্প প্রশাসনের নেওয়া কিছু সিদ্ধান্তের কথা বলা হচ্ছে।
তবে, নতুন করে যারা বেকার হচ্ছেন, তাদের সংখ্যা এখনো কম। যদিও, আগে থেকে বেকার থাকা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। নতুন শ্রম বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত সপ্তাহে প্রথমবারের মতো বেকারত্বের সুবিধা চেয়ে আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল ২ লাখ ১৮ হাজার, যা আগের সপ্তাহের তুলনায় সামান্য বেশি। এছাড়া, দীর্ঘদিন ধরে বেকার রয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে, যা উদ্বেগের কারণ।
চ্যালেঞ্জার, গ্রে অ্যান্ড ক্রিসমাসের (Challenger, Gray & Christmas) তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসে ৬২ হাজার ৭৫ জন কর্মী ছাঁটাই হয়েছেন, যা জুনের তুলনায় ২৯ শতাংশ বেশি।
চ্যালেঞ্জার, গ্রে অ্যান্ড ক্রিসমাসের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু চ্যালেঞ্জার বলেন, “আমরা দেখছি, সরকারি ব্যয় হ্রাসের কারণে অলাভজনক সংস্থা এবং স্বাস্থ্যখাতে এর প্রভাব পড়ছে। গত মাসে ১০ হাজারের বেশি কর্মী আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কারণে চাকরি হারিয়েছেন এবং শুল্ক সংক্রান্ত উদ্বেগের কারণে এ বছর প্রায় ৬ হাজার কর্মীর চাকরি গেছে।”
জুন মাসে বেকারত্বের হার কমলেও, শ্রমশক্তির আকারও কমেছে, যা উদ্বেগের আরেকটি কারণ। অভিবাসন বিষয়ক নীতিতেও পরিবর্তন আসায় শ্রমশক্তির ওপর এর প্রভাব পড়েছে।
ওয়েলস ফার্গো-র অর্থনীতিবিদদের মতে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এখন পর্যন্ত শ্রমশক্তির বৃদ্ধিতে বিদেশি কর্মীদের অবদান প্রায় ৭৫ শতাংশ। সম্প্রতি অবৈধ অভিবাসন কমানোর যে চেষ্টা চলছে, তার কারণে শ্রমশক্তির আকার আরও সংকুচিত হতে পারে।
বর্তমানে স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক সহায়তা এবং স্থানীয় সরকার খাতে বেশি কর্মী নিয়োগ হচ্ছে। তবে, গ্রীষ্মকালে এবং কিছু কিছু কোম্পানির আর্থিক বছরের শুরুতে সাধারণত কাজের সুযোগ কমে যায়।
নৌবাহিনী ফেডারেল ক্রেডিট ইউনিয়নের হিদার লং-এর মতে, “স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষাখাত বাদে অন্য সব খাতে চাকরির বাজার এক প্রকার স্থবির হয়ে আছে, যা চাকরি প্রার্থীদের জন্য কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করেছে।”
জুন মাসে বেকারদের গড় কর্মহীন থাকার সময় বেড়ে ২৩ সপ্তাহ হয়েছে। এছাড়া, যারা ২৭ সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে কাজ খুঁজছেন, তাদের সংখ্যাও বেড়েছে, যা প্রায় তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
জুলাই মাসে স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক সহায়তা এবং অবসর ও আতিথেয়তা খাতে কাজের সুযোগ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বেসরকারি শিল্পখাতে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি কেমন, তা জানতে জুন মাসের ডিফিউশন ইনডেক্স (diffusion index) ছিল ৪৯.৬। এই সূচক যদি ৫০-এর নিচে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে, নতুন চাকরির চেয়ে চাকরি হারানোর সংখ্যা বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুল্কের কারণে কিছু পণ্যের দাম বাড়ছে, যা বাজারে দেখা যাচ্ছে। তবে, এর চেয়েও বড় প্রভাব হলো, এটি শ্রমবাজারে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।
হিদার লং মনে করেন, শুল্ক সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা, মহামারী পরবর্তী কর্মী ব্যবস্থাপনার স্বাভাবিকীকরণ এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের প্রভাব—এই তিনটি বিষয় শ্রমবাজারের ওপর প্রভাব ফেলছে।
যদিও মজুরি এখনো মূল্যস্ফীতির চেয়ে বেশি, তবে অর্থনৈতিক মন্দা এবং ঋণের বোঝা বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় চাপ বাড়ছে।
হিদার লং বলেন, “আমি আশা করি, গ্রীষ্মের শেষ নাগাদ শুল্ক নিয়ে একটা নিশ্চয়তা আসবে এবং সেপ্টেম্বরের মধ্যে সুদের হার কমানো হবে।”
তথ্যসূত্র: সিএনএন