জাপানে পোকামাকড়ের প্রতি মানুষের ভালোবাসা একটি অসাধারণ বিষয়। পশ্চিমা বিশ্বে যেখানে পোকামাকড়কে অনেক সময় এড়িয়ে যাওয়া হয়, সেখানে জাপানে তারা কেবল উপেক্ষিতই নয়, বরং প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। পোকামাকড় সেখানে মানুষের কাছে প্রিয় পোষা প্রাণী, যা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়।
প্রাচীন “টেল অফ গেঞ্জি” থেকে শুরু করে আধুনিক “মুশিশি”-র মতো জনপ্রিয় মাঙ্গা এবং অ্যানিমেশনগুলোতেও পোকামাকড়ের উপস্থিতি জাপানি সংস্কৃতিতে গভীরভাবে প্রোথিত। জাপানিরা বাগানে আলো ছড়ানো জোনাকি অথবা খাঁচায় রাখা ঝিঁঝিঁ পোকার মৃদু শব্দ ভালোবাসে। পোকামাকড়ের খাদ্য হিসেবে তরমুজ দেওয়ার পাশাপাশি, দোকানে তাদের জন্য বিশেষ জেলিও পাওয়া যায়। এমনকি, কিছু দুর্লভ প্রজাতির পোকামাকড় ২০,০০০ ইয়েন (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৫,০০০ টাকা)-এ বিক্রি হয়।
জাপানে পোকামাকড় শিকার করা বা তাদের নিয়ে গবেষণা করাটা সেলিব্রিটিদের কাছেও একটি পছন্দের বিষয়। পাশ্চাত্যের কোনো অভিনেতা যেমন তার ইয়ট বা গল্ফ খেলার স্কোর নিয়ে কথা বলেন, তেমনই জাপানের তারকারা পোকামাকড়ের প্রতি তাদের ভালোবাসার কথা প্রকাশ করেন। এটি প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের একাত্মতার গভীর উপলব্ধির প্রতিফলন।
ক্যুশু বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োএনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মুনিতোশি মারুয়ামা, যিনি ছোটবেলা থেকেই পোকামাকড়ের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন, বলেন, “এরা এত ছোট যে তাদের নিয়ে গবেষণা করলে নতুন কিছু আবিষ্কার করা যায়। এদের আকার ও গঠনও খুব সুন্দর।
মারুয়ামা নিজে ২৫০টির বেশি নতুন প্রজাতির পোকামাকড় আবিষ্কার করেছেন।
জাপানে শিশুদের মধ্যে পোকামাকড়ের প্রতি আগ্রহ তৈরি করতে উৎসাহিত করা হয়। তাদের জন্য লেখা হয় নানান ধরনের বই, আয়োজন করা হয় বিভিন্ন ক্লাস ও ভ্রমণের। এমনকি, মুদি দোকানেও পোকামাকড় ধরার জাল পাওয়া যায়। পোকামাকড় যে বিজ্ঞানচর্চার একটি চমৎকার মাধ্যম হতে পারে, তা সত্যিই অসাধারণ।
কীটপতঙ্গ যে রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যায়, যেমন—লার্ভা থেকে প্রজাপতিতে পরিণত হওয়া, তা শিশুদের জন্য একটি আকর্ষণীয় বিষয়। এর মাধ্যমে তারা জীবনের বিভিন্ন স্তর সম্পর্কে জানতে পারে।
পোকামাকড়ের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যেতে পারে। মৌমাছি ও পিঁপড়ের মতো সামাজিক কীটপতঙ্গ তাদের যোগাযোগের মাধ্যমে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয়, যা তাদের কলোনিগুলোর টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য।
পোকামাকড় বাস্তুতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তারা ফসলের পরাগায়ন ঘটায় এবং পাখি ও অন্যান্য বন্য প্রাণীর খাদ্য হিসেবে কাজ করে। পোকামাকড় যদি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়, তবে মানুষের জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়বে।
টোকিওর ‘দ্য গ্রেট ইনসেক্ট এক্সিবিশন’-এ পোকামাকড়ের প্রতি মানুষের ভালোবাসার প্রমাণ পাওয়া যায়। স্কাই ট্রি টাওয়ারে আয়োজিত এই প্রদর্শনীতে শিশুরা ইনডোর খাঁচায় রাখা গাছের পাশে ভিড় করে বিভিন্ন ধরনের বিটল বা গুবরে পোকা দেখতে ও তাদের স্পর্শ করতে যায়।
ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে পাওয়া যাওয়া “হারকিউলিস” নামক এক ধরনের রাইনোসরাস বিটল-এর রেকর্ড সবচেয়ে বড় গুবরে পোকা হিসেবে স্বীকৃত। এর পিঠের খোলস চকচকে খাকি রঙের, যা ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। এর শিং এবং কাঁটাযুক্ত পাগুলো গাঢ় রঙের হয়ে থাকে।
এই প্রদর্শনীর অন্যতম আয়োজক তোয়োজ়ি সুজুকি বলেন, “আমরা চাই শিশুরা পোকামাকড় স্পর্শ করার আনন্দ অনুভব করুক। এটি তাদের মস্তিষ্কের জন্য খুবই ইতিবাচক।
চার বছর বয়সী আসাহি ইয়ামাউচি, যিনি তার ঠাকুরমার সঙ্গে প্রদর্শনীতে এসেছিলেন, গুবরে পোকার মতো দেখতে একটি বিশেষ স্থাপনার ভিতরে ছবি তুলেছিল। আসাহি পোকামাকড়কে ডাইনোসরের মতোই ভালোবাসে এবং তার বাড়িতে একটি সুন্দর গুবরে পোকা পোষা প্রাণী হিসেবে রয়েছে।
আসাহি জানায়, “আমার বন্ধুর একটা ছিল, তাই আমিও একটা চেয়েছিলাম।”
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস