যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নীতির এক নতুন মোড়, যা বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে চীন থেকে সরবরাহ শৃঙ্খল সরিয়ে নেওয়ার যে প্রবণতা শুরু হয়েছিল, তার ফলস্বরূপ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো, বিশেষ করে বাংলাদেশ, নতুন শুল্কের কবলে পড়েছে।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। গত এক দশকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ তীব্র হওয়ার পরে, অনেক বিদেশি এবং চীনা কোম্পানি তাদের সরবরাহ ব্যবস্থা চীনের বাইরে সরিয়ে নিতে শুরু করে।
এর ফলস্বরূপ, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো, যেমন – বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড-এর মতো দেশগুলো গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য হয়ে ওঠে। কারণ এখানে শ্রম খরচ তুলনামূলকভাবে কম ছিল। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন পদক্ষেপের কারণে এই দেশগুলো এখন উচ্চ শুল্কের সম্মুখীন হচ্ছে।
এমনকি “ট্রান্সশিপমেন্ট”-এর (এক দেশ থেকে অন্য দেশে পণ্য চালান করে, সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো) ওপরও নতুন করে ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই শুল্কগুলো শুধু ইতিহাসের দিক থেকেই বেশি নয়, এর ফলে বাজারের পরিস্থিতিও দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে, যা মার্কিন ভোক্তাদের জন্যও উদ্বেগের কারণ। অনেক আঞ্চলিক নেতা প্রাথমিকভাবে নতুন শুল্ক হারের বিষয়ে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানালেও, বিশেষজ্ঞরা এর গভীর প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করেছেন।
তারা বলছেন, এই শুল্কগুলি এই অঞ্চলের দেশগুলির অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য সম্পর্ককে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে পারে।
এই শুল্কের অন্যতম শিকার হতে পারে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প। যদিও প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের জন্য শুল্কের হার তুলনামূলকভাবে কম (২০%) নির্ধারিত হয়েছে, তবে ট্রান্সশিপমেন্টের ওপর আরোপিত নতুন শুল্ক এই শিল্পের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।
কারণ, এর ফলে বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুতকারকদের খরচ বাড়বে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের প্রতিযোগিতার ক্ষমতা হ্রাস পাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের মূল লক্ষ্য হলো চীনের বাণিজ্যপথ বন্ধ করা। এর ফলে, চীন থেকে আসা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে, যা প্রকারান্তরে এই অঞ্চলের দেশগুলোতে উৎপাদিত পণ্যের ওপরও প্রভাব ফেলছে।
উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো চীনা প্রস্তুতকারক তাদের পণ্য ভিয়েতনামে পাঠিয়ে, সামান্য পরিবর্তনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠায়, তাহলে সেই পণ্যের ওপরও উচ্চ শুল্ক আরোপ করা হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে অনেক কোম্পানি এখন তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখা নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই শুল্কের কারণে সরবরাহ শৃঙ্খলে পরিবর্তন আসবে। অনেক কোম্পানি হয়তো চীন থেকে তাদের উৎপাদন সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে পারে। বিশেষ করে, কম মুনাফার পোশাক ও খেলনার মতো শ্রম-নিবিড় শিল্পগুলো চীনে ফিরে যেতে পারে।
আবার, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ওপর নির্ভরশীল পণ্য, যেমন – গৃহস্থালীর সরঞ্জাম প্রস্তুতকারকদের জন্য কাছাকাছি কোনো দেশে উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করা লাভজনক হতে পারে।
তবে, সবাই একমত নন যে এই শুল্ক চীনের বাইরে উৎপাদন সরানোর প্রবণতা সম্পূর্ণ বন্ধ করতে পারবে। কিছু অর্থনীতিবিদ মনে করেন, চীনের শ্রম খরচ বাড়ছে এবং কিছু শ্রম-নিবিড় শিল্পে তারা তাদের প্রতিযোগিতামূলক ক্ষমতা হারাচ্ছে।
তাই, এই শুল্কের কারণে চীনের বিনিয়োগে খুব বেশি প্রভাব নাও পড়তে পারে। বরং, এই পদক্ষেপ চীনের প্রস্তুতকারকদের জন্য বিদেশে তাদের ব্যবসা আরও প্রসারিত করতে উৎসাহিত করতে পারে।
ট্রাম্প প্রশাসনের এই বাণিজ্য নীতির ফলে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এর পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য সম্পর্কও নতুন রূপ নিতে পারে।
বাংলাদেশের জন্য, এই পরিস্থিতি একদিকে যেমন উদ্বেগের কারণ, তেমনি সুযোগও সৃষ্টি করতে পারে। সরকার ও বাণিজ্য সংগঠনগুলোকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে পোশাক শিল্পসহ দেশের অর্থনীতি এই নতুন বাণিজ্য পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকতে পারে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন