মহাকাশ এখন নতুন যুদ্ধক্ষেত্র? রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের আবহে স্যাটেলাইট দখলের ঘটনা এবং মহাকাশ অস্ত্রের প্রতিযোগিতা নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মহাকাশ হয়ে উঠেছে সামরিক শক্তি প্রদর্শনের এক নতুন স্থান। স্যাটেলাইট প্রযুক্তি এখন সামরিক কার্যকলাপ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন পর্যন্ত অপরিহার্য। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি এখন হুমকির মুখে।
রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের সময়, হ্যাকাররা ইউক্রেনের টিভি চ্যানেলে হানা দিয়ে মস্কোর বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজের দৃশ্য সম্প্রচার করে। এই ঘটনা বুঝিয়ে দেয়, যুদ্ধ এখন শুধু স্থল, জল বা আকাশেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সাইবার জগৎ এবং মহাকাশেও এর বিস্তার ঘটেছে।
স্যাটেলাইট অচল করে দেওয়া হলে, তা কোনো বোমা ব্যবহার না করেই ব্যাপক ক্ষতিসাধন করতে পারে। স্যাটেলাইটের নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল করে বা পৃথিবী থেকে পাঠানো সংকেত বন্ধ করে এই কাজটি করা সম্ভব।
সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ টম পেস বলেন, “যদি আপনি একটি স্যাটেলাইটের যোগাযোগে বাধা দিতে পারেন, তবে এর ফলে গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবাগুলোতে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটবে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, “ধরুন, যদি কোনো দেশের মানুষ জিপিএস-এর সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে কি ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে, তা একবার ভেবে দেখুন।
বর্তমানে, পৃথিবীর চারপাশে ১২,০০০ এর বেশি স্যাটেলাইট সক্রিয় রয়েছে। এই স্যাটেলাইটগুলো সামরিক কার্যক্রম, নেভিগেশন সিস্টেম, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং অর্থনৈতিক সরবরাহ শৃঙ্খলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ক্ষেপণাস্ত্র হামলার আগাম সতর্কতার ক্ষেত্রেও এগুলো জরুরি।
এই কারণে, স্যাটেলাইটগুলো এখন যেকোনো দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য দুর্বল স্থান, যা প্রতিপক্ষের অর্থনীতি বা সামরিক সক্ষমতাকে দুর্বল করতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
রাশিয়ার সমর্থনে হ্যাকাররা যেমনটা ইউক্রেনের টিভি চ্যানেলের ক্ষেত্রে ঘটিয়েছে, তেমনটা করে জনগণের মধ্যে ভীতিও সঞ্চার করা যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, হ্যাকাররা সাধারণত স্যাটেলাইট পরিচালনার জন্য ব্যবহৃত সফটওয়্যার বা হার্ডওয়্যারের দুর্বলতাগুলো খুঁজে বের করে।
যদিও স্যাটেলাইটটি সুরক্ষিত থাকতে পারে, কিন্তু পুরনো সফটওয়্যার ব্যবহার করা হলে, হ্যাকারদের পক্ষে সেটি ব্যবহার করা সহজ হয়।
২০২২ সালে, যখন রুশ বাহিনী ইউক্রেন আক্রমণ করে, তখন কিয়েভ সরকারের সামরিক বাহিনী যে ‘ভায়াস্যাট’ নামের একটি মার্কিন স্যাটেলাইট পরিষেবা ব্যবহার করত, তার উপর হামলা চালানো হয়।
ইউক্রেন এই হ্যাকের জন্য মস্কোকে দায়ী করে। এই হামলায় কয়েক হাজার মডেম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, যার ফলে ইউরোপের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বলছেন, রাশিয়া এমন একটি মহাকাশ-ভিত্তিক পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে যা স্বল্প কক্ষপথে থাকা প্রায় সব স্যাটেলাইটকে একযোগে ধ্বংস করতে সক্ষম।
এই অস্ত্রের মূল লক্ষ্য হলো স্যাটেলাইটের ইলেক্ট্রনিক্স ব্যবস্থা ধ্বংস করা, যার ফলে অন্যান্য স্যাটেলাইটও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
মার্কিন কংগ্রেসম্যান মাইক টার্নার এই অস্ত্রের বিষয়ে জনসাধারণের মধ্যে সতর্কবার্তা জারি করার পরেই যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা এই তথ্য প্রকাশ করেন।
টার্নার এই অস্ত্রের বিষয়ে আইনপ্রণেতাদের কাছে গোপন ব্রিফিং দেওয়ার জন্য প্রতিরক্ষা বিভাগকে চাপ দিচ্ছেন।
তিনি বলছেন, এই ধরনের অস্ত্র মোতায়েন করা হলে তা মহাকাশে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাবে এবং আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘন করবে।
টার্নারের মতে, এই অস্ত্র ব্যবহারের ফলে এক বছর পর্যন্ত স্যাটেলাইট অচল হয়ে যেতে পারে।
এর ফলস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা অর্থনৈতিক সংকট এবং এমনকি পারমাণবিক হামলার ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।
রাশিয়া এবং চীনও তাদের স্যাটেলাইট হারাতে পারে, যদিও তারা যুক্তরাষ্ট্রের মতো স্যাটেলাইটের উপর এত নির্ভরশীল নয় বলেই ধারণা করা হয়।
এই অস্ত্রের সম্ভাব্য প্রভাবের কথা উল্লেখ করে টার্নার এটিকে ১৯৫৭ সালে রাশিয়ার পাঠানো স্পুটনিকের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
তিনি বলেন, “যদি এই অ্যান্টি-স্যাটেলাইট পারমাণবিক অস্ত্র মহাকাশে স্থাপন করা হয়, তবে এটি মহাকাশ যুগের সমাপ্তি ডেকে আনবে।
সেটিকে মহাকাশে যেতে দেওয়া উচিত হবে না।
এটি মহাকাশে কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের মতোই একটি পরিস্থিতি তৈরি করবে।
চন্দ্র ও অন্যান্য গ্রহাণু থেকে মূল্যবান খনিজ ও অন্যান্য উপাদান আহরণের সম্ভাবনা ভবিষ্যতে দেশগুলোর মধ্যে নতুন করে সংঘাতের সৃষ্টি করতে পারে।
মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার প্রশাসক জানিয়েছেন, তারা চাঁদে একটি ছোট পারমাণবিক চুল্লি (রিয়্যাক্টর) পাঠানোর পরিকল্পনা করছেন।
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই চীন ও রাশিয়ার আগে সেখানে পৌঁছাতে হবে।
চাঁদে হিলিয়াম-৩ নামের একটি উপাদান রয়েছে, যা পারমাণবিক ফিউশন প্রক্রিয়ায় বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপাদনে ব্যবহার করা যেতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন।
যদিও এই প্রযুক্তি এখনো কয়েক দশক দূরে, তবে এর নিয়ন্ত্রণ ভবিষ্যতে দেশগুলোকে পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
ঠান্ডা যুদ্ধের অবসানের পর মহাকাশ গবেষণায় বিনিয়োগ কিছুটা কমে গিয়েছিল, তবে চাঁদে খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানের সম্ভাবনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিযোগিতা আবারও বাড়ছে।
লন্ডনের সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ জোসেফ রুক বলেছেন, “এটা আর কল্পবিজ্ঞান নয়, দ্রুতই বাস্তব হতে চলেছে।
যদি কোনো দেশ পৃথিবীর শক্তির চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তবে তাদের জয় নিশ্চিত।
চীন ও রাশিয়াও আগামী বছরগুলোতে চাঁদে তাদের নিজস্ব পারমাণবিক কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে।
একইসঙ্গে, যুক্তরাষ্ট্রও চাঁদ ও মঙ্গলে মিশন পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির চাহিদা এই প্রতিযোগিতাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।
তবে, চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা কোনো মহাকাশ অস্ত্র প্রতিযোগিতার পক্ষে নয়।
চীনের দূতাবাস থেকে জানানো হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রই মহাকাশকে সামরিকীকরণের চেষ্টা করছে এবং সামরিক জোট তৈরি করছে।
চীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, তারা যেন মহাকাশে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করা থেকে বিরত থাকে।
মহাকাশে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে এবং বিদেশি স্যাটেলাইটের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে বিভিন্ন দেশ নিজস্ব রকেট ও মহাকাশ প্রোগ্রাম তৈরি করতে চাইছে।
এই কাজটি বেশ কঠিন এবং ব্যয়বহুল।
সম্প্রতি, অস্ট্রেলিয়ার তৈরি প্রথম রকেট উৎক্ষেপণের ১৪ সেকেন্ডের মধ্যেই বিধ্বস্ত হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের মহাকাশ বিষয়ক স্বার্থ রক্ষার জন্য ২০১৯ সালে ‘স্পেস ফোর্স’ তৈরি করেছে।
যদিও এই বাহিনী সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী বা বিমানবাহিনীর চেয়ে ছোট, তবে এটি ধীরে ধীরে বাড়ছে।
এর সদর দপ্তর কোথায় হবে, সেটিও খুব শীঘ্রই ঘোষণা করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী বর্তমানে একটি মনুষ্যবিহীন মহাকাশ শাটল পরিচালনা করে, যা সামরিক মিশন ও গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হয়।
এই যানটি এক বছরের বেশি সময় ধরে মহাকাশে থাকার পর সম্প্রতি পৃথিবীতে ফিরে এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের স্পেস ফোর্স মহাকাশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থ হিসেবে বিবেচনা করে।
তাদের মতে, মহাকাশ একটি যুদ্ধক্ষেত্র এবং স্পেস ফোর্সের কাজ হলো জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এই পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কয়েক দশক ধরে মহাকাশে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য ছিল।
কিন্তু রাশিয়া ও চীনের নতুন হুমকি এবং প্রতিযোগিতা এই পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আনছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলছেন, এর মোকাবিলায় আগ্রাসী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
কংগ্রেসম্যান টার্নারের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য হলো রাশিয়া ও চীনকে সুবিধা পেতে না দেওয়া এবং মহাকাশ অস্ত্রের ভয়ঙ্কর সম্ভাবনাকে বাস্তব হতে না দেওয়া।
তিনি বলেন, “এই বিষয়গুলোর প্রতি আমাদের মনোযোগ দিতে হবে, যাতে এমনটা না ঘটে।
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস