পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহতা: বিশ্বজুড়ে এখনো চলছে তার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েক দশক পরেও পারমাণবিক অস্ত্রের ধ্বংসাত্মক প্রভাব আজও বিশ্বজুড়ে অনুভূত হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলার ফলে কয়েক লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, যা পারমাণবিক অস্ত্রের বিভীষিকা সম্পর্কে বিশ্বকে প্রথম ধারণা দেয়।
এরপর বিভিন্ন দেশ তাদের সামরিক শক্তি প্রদর্শনের জন্য একের পর এক পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালায়, যার ফলস্বরূপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেখানকার মানুষ ও পরিবেশ।
গত ৮০ বছরে বিশ্বে দুই হাজারের বেশি পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। এই পরীক্ষাগুলোর কেন্দ্র ছিল মূলত জনবসতিহীন এলাকাগুলো, যেমন—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেভাদা, প্রশান্ত মহাসাগরের মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ, কাজাখস্তানের সেমিপালাতিনস্ক, এবং আরও কিছু স্থানে।
এইসব অঞ্চলের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রা, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের উপর এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছে। স্থানীয় অধিবাসীরা, যাদের মধ্যে “ডাউনউইন্ডার” নামে পরিচিত একটি গোষ্ঠীও ছিল, তেজস্ক্রিয়তার শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ক্যান্সার, অটোইমিউন রোগ এবং জন্মগত ত্রুটির মতো স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো দেখা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা (ইপিএ) জানাচ্ছে, তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে আসার কারণে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। এই ঝুঁকি তেজস্ক্রিয়তার মাত্রার সঙ্গে বৃদ্ধি পায়।
নেভাদাতে পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষার ফলে সেখানকার মানুষজন বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত সমস্যায় পড়েছেন। সেখানকার বাসিন্দা মেরি ডিকসন জানান, তার শৈশবের প্রতিবেশীদের মধ্যে অনেকেই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি নিজেও থাইরয়েড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
কাজাখস্তানের সেমিপালাতিনস্কে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরীক্ষার স্থান ছিল। সেখানকার বাসিন্দা আইগারিাম সেইতেনোভা জানান, তার পরিবারের অনেকেই অল্প বয়সে মারা গেছেন এবং তাদের শরীরে দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিয়েছে।
মার্শাল দ্বীপপুঞ্জে চালানো পারমাণবিক পরীক্ষার ফলস্বরূপ সেখানকার মানুষজন বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এবং তাদের অনেকে এখনো পর্যন্ত নিজেদের স্থানে ফিরতে পারেননি। এখানকার মাটি ও খাদ্যশস্যে তেজস্ক্রিয়তার উপস্থিতি সেখানকার মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, নারকেল গাছের মতো স্থানীয় উদ্ভিদের মাধ্যমে তেজস্ক্রিয়তা খাদ্যের মধ্যে প্রবেশ করে, যা মানুষের শরীরে আরও বেশি ক্ষতিসাধন করে।
পারমাণবিক পরীক্ষার ফলে সৃষ্ট ক্ষতির শিকার ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, “রেডিয়েশন এক্সপোজার কম্পেনসেশন অ্যাক্ট” (RECA)-এর অধীনে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে।
তবে, ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, এই ক্ষতিপূরণ তাদের প্রকৃত ক্ষতির তুলনায় অনেক কম। ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যও তাদের পারমাণবিক পরীক্ষার শিকার ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারমাণবিক অস্ত্রের প্রভাব শুধু একটি দেশের সমস্যা নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এই অস্ত্রের ব্যবহার ও পরীক্ষার ফলে সৃষ্ট দূষণ মানবজাতি এবং পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করে।
পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সহায়তার হাত বাড়ানো জরুরি।
তথ্য সূত্র: সিএনএন