চুপিসারে বাড়ছে মূল্য: ট্রাম্পের শুল্কের শিকার?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের শুল্ক নীতির কারণে কীভাবে ধীরে ধীরে বাড়ছে পণ্যের দাম?

যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে বিভিন্ন পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের ফলে এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে সাধারণ আমেরিকান নাগরিকদের ওপর। ট্রাম্প যদিও দাবি করেছিলেন যে, শুল্কের বোঝা বহন করবে বিদেশি কোম্পানি ও দেশগুলো, কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র।

বিভিন্ন অর্থনৈতিক তথ্য, গবেষণা এবং সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা বলছে, শুল্কের কারণে পণ্যের দাম বাড়ছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে আমেরিকান ব্যবসা এবং ভোক্তাদের উপর।

ট্রাম্প তার সামাজিক মাধ্যম ‘ট্রুথ সোশালে’ এক পোস্টে দাবি করেন, ‘শুল্কের কারণে আমেরিকায় মূল্যবৃদ্ধি বা অন্য কোনো সমস্যা হয়নি, বরং এতে সরকারের কোষাগারে বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা হয়েছে। এছাড়াও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভোক্তারা শুল্কের বোঝা বহন করে না, বরং কোম্পানি ও সরকারগুলোই এর খরচ বহন করে, যার মধ্যে অনেক বিদেশি সরকারও রয়েছে।’

কিন্তু বাস্তবতা হলো ভিন্ন। অর্থনৈতিক তথ্য বলছে, শুল্কের কারণে আমদানি পণ্যের দাম বাড়ছে, যা ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ভোক্তাদেরও বাড়তি দামে পণ্য কিনতে বাধ্য করছে।

উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো বিদেশি কোম্পানি শুল্কের কারণে তাদের পণ্যের দাম কমায়, তবে এর প্রভাব দেখা যেত আমদানি মূল্যে। কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোর তথ্য বলছে, আমদানি মূল্য স্থিতিশীল রয়েছে। নভেম্বরের নির্বাচনের পর থেকে এই মূল্য ০.৫% এবং মার্চের পর থেকে ০.২% বেড়েছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, আগে ধারণা করা হচ্ছিলো, বিদেশি রপ্তানিকারকরা হয়তো দাম কমাচ্ছে, কিন্তু সেই ধারণা এখন টেকে না। কারণ, বাজারে পণ্যের চাহিদা এখনো বেশ ভালো, তাই দাম কমানোর কোনো চাপ নেই তাদের ওপর।

বিশেষজ্ঞদের মতে, চীন থেকে আসা কিছু পণ্যের দাম সামান্য কমলেও, বেশিরভাগ দেশ থেকেই আমদানি করা পণ্যের দাম একই রয়েছে। এর মানে হলো, শুল্কের পুরোটাই এখন ব্যবসায়ীদের বহন করতে হচ্ছে।

এখন প্রশ্ন হলো, এই বোঝা কতটুকু প্রস্তুতকারক, কতটুকু খুচরা বিক্রেতা, এবং কতটুকুই বা ছোট ব্যবসায়ীরা নিবে? তারা এখন হিসাব মেলাচ্ছে, কতটুকু তারা নিজেরাই বহন করবে, আর কতটুকুই তারা ভোক্তাদের উপর চাপাবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্ভবত তারা এই মূল্যের একটা বড় অংশ ভোক্তাদের উপর চাপিয়ে দেবে। যদিও শুরুতে ভোক্তারা সরাসরি এই মূল্যবৃদ্ধির শিকার হয়নি, তবে গোল্ডম্যান স্যাক্সের অর্থনীতিবিদদের মতে, জুনের মধ্যে ভোক্তারা শুল্কের ২২% খরচ বহন করেছে, যা অক্টোবরের মধ্যে ৬৭% এ পৌঁছাতে পারে।

এমনকি, এই খরচ ১০০% পর্যন্ত হতে পারে, যদি দেশীয় উৎপাদকরাও তাদের পণ্যের দাম বাড়ায়।

শুল্কের কারণে দাম বৃদ্ধির কিছু কারণ রয়েছে। যেমন – ব্যবসায়ীরা আগেই শুল্কমুক্ত পণ্য গুদামজাত করে রেখেছিল, সরবরাহ শৃঙ্খলে দাম ভাগাভাগি করা হচ্ছে, এবং ট্রাম্পের শুল্ক নীতিতে কিছু পরিবর্তন আসায় অনেক পণ্যের ওপর এখনই শুল্ক কার্যকর হয়নি।

অন্যদিকে, বাজারে মূল্যস্ফীতি এখনো নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এর কারণ হিসেবে দেখা যায়, কিছু পণ্যের দাম কমে যাওয়া, যা মহামারী পরবর্তী সংকট থেকে উত্তরণের ইঙ্গিত দেয়। এছাড়াও, বিশ্ব অর্থনীতির অনিশ্চয়তার কারণে গ্যাসের দাম কমেছে এবং ভ্রমণের মতো কিছু ক্ষেত্রে ভোক্তার চাহিদা কমেছে।

তবে, সম্প্রতি প্রকাশিত ভোক্তা মূল্য সূচক (Consumer Price Index) অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র যেসব পণ্য বেশি আমদানি করে, যেমন – গৃহস্থালীর সরঞ্জাম, পোশাক, খেলনা ও ক্রীড়া সামগ্রী, সেগুলোর দাম বাড়ছে।

হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক আলবার্তো কাভালোর গবেষণা বলছে, বর্তমানে আমদানি করা পণ্যের দাম শুল্কের আগের দামের চেয়ে ৫% বেশি এবং দেশীয় উৎপাদিত পণ্যের দাম ৩% বেশি।

কাভালো মনে করেন, এই দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে চলবে, তবে পণ্যের ধরন এবং বাজারের প্রতিযোগিতার ওপর এর প্রভাব নির্ভর করবে।

আটলান্টা ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের নতুন গবেষণা দেখাচ্ছে, ব্যবসায়ীরা – যারা সরাসরি শুল্কের আওতায় পড়েছে এবং যারা পড়েনি – উভয়েই এই বছর পণ্যের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে।

২০২৪ সালের শেষ দিকে ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্যের দাম ২.৫% বাড়ানোর পূর্বাভাস দিলেও, মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে সেই পূর্বাভাস বেড়ে ৩.৫% হয়। এমনকি, পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোও দাম বাড়াতে পারে, যা ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়াতে পারে।

গুগেনহেইম ইনভেস্টমেন্টের মার্কিন অর্থনীতিবিদ ম্যাট বুশ মনে করেন, ব্যবসায়ীরা আপাতত সরবরাহকারী এবং ভোক্তাদের সঙ্গে দাম ভাগাভাগি করার চেষ্টা করছে।

তবে, শুল্ক যদি বহাল থাকে, তাহলে তারা ধীরে ধীরে এই খরচ ভোক্তাদের উপর চাপাতে শুরু করবে।

ওয়ালমার্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ডগ ম্যাকমিলন জানিয়েছেন, শুল্কের কারণে তাদের খরচ প্রতি সপ্তাহে বাড়ছে, তবে তারা চেষ্টা করছেন দাম স্থিতিশীল রাখতে।

ছোট ছোট এই মূল্যবৃদ্ধি হয়তো কিছু ভোক্তার জন্য সহজ হবে, কিন্তু যাদের সীমিত বাজেট, তাদের জন্য এটি একটি কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করবে।

বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষেরা তাদের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে হিমশিম খাবে। উদাহরণস্বরূপ, হয়তো তাদের সন্তানদের জুতা কেনার জন্য এক সপ্তাহ মাংস বা কফি খাওয়া বন্ধ করতে হতে পারে, অথবা বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করতে গিয়ে গাড়ি কিস্তির টাকা জমা দিতে পারবে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খুচরা বিক্রেতা এবং বড় ব্র্যান্ডগুলো জানে যে অনেক আমেরিকান দিন আনে দিন খায়।

তাই তারা ‘স্নিকফ্লেশন’ বা লুকানো মূল্যবৃদ্ধির আশ্রয় নিচ্ছে। অর্থাৎ, দাম অল্প অল্প করে বাড়ানো হচ্ছে, যাতে ভোক্তারা সহজে বুঝতে না পারে বা এই খরচ বহন করতে পারে।

এই পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশের ভোক্তাদের জন্য বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বিশ্ব অর্থনীতির এই পরিবর্তনের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়লে, তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়তে পারে।

বিশেষ করে, খাদ্যপণ্য, পোশাক, এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়লে, সীমিত আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় আরও বেশি চাপ সৃষ্টি হবে।

তথ্যসূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *