**মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার কমানোর সম্ভাবনা: বিশ্ব অর্থনীতি ও বাংলাদেশের জন্য এর প্রভাব**
অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। এই হার কমানো বা বাড়ানোর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলি (Central Banks) বাজারে অর্থের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে এবং অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে এর প্রভাব ফেলে।
সম্প্রতি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক (Federal Reserve), যা দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসাবে পরিচিত, সুদের হার কমানোর ইঙ্গিত দিয়েছে। এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি নতুন পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, যা বাংলাদেশকে সরাসরি প্রভাবিত করতে পারে।
ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল (Jerome Powell) সম্প্রতি দেওয়া এক ভাষণে সুদের হার কমানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন। যদিও সুদের হার কমানোর বিষয়টি অর্থনৈতিক তথ্যের ওপর নির্ভরশীল, তবে বাজার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আগামী সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে ফেডারেল রিজার্ভ তাদের পরবর্তী বৈঠকে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
ব্যাংকারেট-এর প্রধান আর্থিক বিশ্লেষক গ্রেগ ম্যাকব্রাইড (Greg McBride) সতর্ক করে বলেছেন, “সেপ্টেম্বরে হার কমানোর সম্ভাবনা প্রবল হলেও, এখনো চূড়ান্ত কিছু হয়নি।”
তবে, সুদের হার কমানোর খবরে বিনিয়োগকারীরা বেশ খুশি হয়েছেন। এর ফলস্বরূপ, গত শুক্রবার ডাউ জোনস ইন্ডাস্ট্রিয়াল এভারেজ (Dow Jones Industrial Average) ৮০০ পয়েন্ট বেড়ে রেকর্ড গড়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তের ফলে আমাদের ব্যক্তিগত আর্থিক জীবনে কী প্রভাব পড়তে পারে?
প্রথমত, এর একটি সম্ভাব্য প্রভাব হলো সঞ্চয় এবং ফিক্সড ডিপোজিট-এর উপর সুদের হার কমে যাওয়া। যখন ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার কমায়, তখন ব্যাংকগুলিও তাদের সঞ্চয় এবং ফিক্সড ডিপোজিটের উপর সুদের হার কমাতে শুরু করে।
ম্যাকব্রাইড-এর মতে, “সুদের হার কমানোর ঘোষণার কাছাকাছি সময়ে সঞ্চয়ের হার কমতে শুরু করবে এবং হার কমানো শুরু হলে এর গতি আরও বাড়বে।
দ্বিতীয়ত, নতুন ঋণের ক্ষেত্রে সুদের হার কমতে পারে। যদি কোনো ব্যক্তি নতুন করে ঋণ নিতে চান, তাহলে সুদের হার হয়তো কমতে পারে।
তবে, ব্যাংকগুলো সাধারণত সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে সুদের হার কমানোর মতো দ্রুত হারে ঋণের সুদ কমায় না। কার্ডরেটস ডটকম-এর সার্টিফাইড ফিনান্সিয়াল প্ল্যানার ববি রেবেল (Bobbi Rebell) জানিয়েছেন, “ঋণদাতাদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে, সুদের হার কমানোর ক্ষেত্রে ভোক্তারা হয়তো প্রত্যাশার চেয়ে ধীর গতি দেখতে পারেন।
তৃতীয়ত, ক্রেডিট কার্ডের সুদের হারেও পরিবর্তন আসতে পারে। সাধারণত, ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার কমালে ক্রেডিট কার্ড প্রদানকারী সংস্থাগুলিও তাদের ভেরিয়েবল রেট কমায়।
তবে এক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগতে পারে (প্রায় তিন মাস)। কিন্তু ক্রেডিট কার্ডের সুদের হার এমনিতেই অনেক বেশি থাকে।
উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রে ক্রেডিট কার্ডের গড় সুদহার এখনো প্রায় ২০ শতাংশের বেশি। তাই, সামান্য সুদ কমালে খুব বেশি সুবিধা নাও পাওয়া যেতে পারে।
চতুর্থত, বন্ধকী ঋণের (mortgages) ক্ষেত্রে সুদের হারের পরিবর্তন ফেডারেল রিজার্ভের সিদ্ধান্তের ওপর সরাসরি নির্ভর করে না।
বন্ধকী ঋণের হার মূলত মার্কিন ট্রেজারি বন্ডের (US Treasury bonds) ফলনের উপর নির্ভরশীল, যা বিভিন্ন অর্থনৈতিক পূর্বাভাসের দ্বারা প্রভাবিত হয়।
ম্যাকব্রাইডের মতে, “মূল্যস্ফীতি, ঋণ এবং ঘাটতি বন্ধকী ঋণের হারকে প্রভাবিত করে এবং সম্ভবত এটি কমার পরিমাণ সীমিত করবে।
যতক্ষণ না অর্থনীতি দুর্বল হতে শুরু করে, সম্ভবত আমরা দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধকী ঋণের হার ৬ শতাংশের নিচে নামতে দেখব না।
তাহলে, বাংলাদেশের জন্য এর তাৎপর্য কী?
যদিও সরাসরি প্রভাব তাৎক্ষণিক নাও হতে পারে, তবে বিশ্ব অর্থনীতির এই পরিবর্তনের ঢেউ আমাদের দেশেও লাগবে। সুদের হার কমালে বিশ্ববাজারে বিনিয়োগের নতুন সুযোগ তৈরি হতে পারে, যা আমাদের দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
তবে, আমাদের দেশের ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের (Bangladesh Bank) নীতি অনুসরণ করে। তাই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তের সরাসরি প্রভাব হয়তো কম হবে, তবে বিশ্ব অর্থনীতির এই পরিবর্তনের দিকে আমাদের অবশ্যই নজর রাখতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সময়ে সময়ে সুদের হার নির্ধারণ করে এবং তা দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও মুদ্রাস্ফীতির ওপর নির্ভর করে।
যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির নীতি বিশ্ব অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে, তাই এর পরিবর্তনগুলো আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য পরামর্শ হলো, তারা যেন তাদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরও সচেতন হন এবং বাজারের পরিবর্তনের দিকে নজর রাখেন।
সেই সঙ্গে, আর্থিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অভিজ্ঞ পরামর্শকের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
তথ্যসূত্র: সিএনএন