মহাকাশ জয়: ইউরোপের নতুন স্বপ্ন, সুইডেনের অরণ্যে লুকিয়ে ভবিষ্যৎ
সুদূর উত্তরে, বরফের দেশ সুইডেনের গভীর অরণ্যে, যেখানে আকাশে ওড়ে নানা রঙের পাখি, সেইখানেই লুকিয়ে আছে ইউরোপের মহাকাশ জয়ের নতুন স্বপ্ন। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে, মহাকাশ গবেষণা এবং প্রযুক্তি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিতে প্রস্তুত হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।
খবর অনুযায়ী, এর মূল কেন্দ্র হলো সুইডেনের কিরুনা অঞ্চলের ‘এসরেঞ্জ স্পেস সেন্টার’।
দীর্ঘদিন ধরে মহাকাশ নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির জন্য ইউরোপ আমেরিকার উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। একদিকে যেমন বাণিজ্যিক মহাকাশ বাজারের দ্রুত বিস্তার ঘটছে, তেমনই যুক্তরাষ্ট্রের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি ইউরোপকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে।
এখন তারা নিজস্ব সক্ষমতা তৈরি করতে চাইছে, যাতে মহাকাশ গবেষণায় স্বনির্ভর হওয়া যায়।
ইউরোপের এই নতুন উচ্চাকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রে রয়েছে ‘এসরেঞ্জ স্পেস সেন্টার’। এটি সুইডিশ স্পেস কর্পোরেশন দ্বারা পরিচালিত হয়।
এখানকার প্রধান আকর্ষণ হলো এর বিশাল এলাকা। এই কেন্দ্রটি ৬ বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে বিস্তৃত, যেখানে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান।
এখানকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বিশাল রকেট অবতরণ এলাকা, যা প্রায় ৫,২০০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত।
এই অঞ্চলে বিরল প্রজাতির গাছপালা ও তুষার আচ্ছাদিত ভূমি রয়েছে, যা পরীক্ষার জন্য খুবই উপযোগী।
বর্তমানে, ইউরোপের একমাত্র মহাকাশ কেন্দ্র, যা থেকে নিয়মিত রকেট ও স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয়, সেটি দক্ষিণ আমেরিকার ফরাসি গায়ানায় অবস্থিত। এছাড়া, তারা যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরালও ব্যবহার করে থাকে।
তবে, মহাকাশ গবেষণায় নিজেদের স্বকীয়তা বাড়াতে ইউরোপ মহাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকেই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করার পরিকল্পনা করছে। নরওয়ের আন্ডোইয়া স্পেসপোর্টও এই প্রকল্পের একটি অংশ।
জার্মানির একটি প্রাইভেট কোম্পানি, ‘আইসার অ্যারোস্পেস’, সম্প্রতি তাদের প্রথম পরীক্ষা চালিয়েছে। যদিও উৎক্ষেপণের কিছু সময় পরেই রকেটটি সমুদ্রে পতিত হয়, তবে এটিকে তারা সফল হিসেবেই দেখছে।
মহাকাশ নীতি বিষয়ক ইউরোপীয় ইনস্টিটিউটের পরিচালক হারমান লুডভিগ ম্যুলার মনে করেন, আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে মহাকাশ গবেষণায় নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা প্রমাণ করতে হলে, ইউরোপকে তাদের বিনিয়োগ দ্বিগুণ করতে হবে।
শুধু তাই নয়, মহাকাশ কেন্দ্র স্থাপনে পর্তুগাল, স্পেন, ইতালি, জার্মানি এবং যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোও আগ্রহ দেখাচ্ছে।
মহাকাশ গবেষণা এখন কেবল কয়েকটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ভারতও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করেছে। তারা নিজস্ব স্যাটেলাইট তৈরি ও উৎক্ষেপণ করেছে এবং এমনকি মঙ্গলের কক্ষপথেও মহাকাশযান পাঠিয়েছে।
নিউজিল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়াও এই খাতে তাদের কার্যক্রম বৃদ্ধি করছে।
মহাকাশ একটি বাণিজ্যিক ক্ষেত্র হিসেবেও দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। এলন মাস্কের স্পেসএক্স এবং জেফ বেজোসের ব্লু অরিজিনের মতো কোম্পানিগুলো প্রমাণ করেছে যে, সরকারি সংস্থাগুলোর বাইরেও এই শিল্পে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।
আগামী পাঁচ বছরে মহাকাশে স্যাটেলাইটের সংখ্যা বহুগুণে বাড়তে চলেছে।
সুইডিশ স্পেস কর্পোরেশন এই সুযোগ কাজে লাগাতে চাইছে।
উপগ্রহ বা স্যাটেলাইট (satellite) প্রযুক্তির গুরুত্ব বর্তমানে অপরিসীম।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, যেমন – মোবাইল ফোনের ডেটা আদান-প্রদান থেকে শুরু করে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা—সবকিছুতেই স্যাটেলাইটের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
ইউরোপের এই মহাকাশযাত্রা শুধু প্রযুক্তিগত অগ্রগতির বিষয় নয়, এটি নিরাপত্তা ও স্বনির্ভরতার সঙ্গেও জড়িত।
বিশ্বজুড়ে যখন বিভিন্ন দেশ নিজেদের সামরিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছে, তখন মহাকাশে নিজস্ব ক্ষমতা থাকাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন মনে করে, মহাকাশে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারলে তারা নিজেদের নিরাপত্তা আরও সুসংহত করতে পারবে।
এক্ষেত্রে, বাংলাদেশের জন্যেও রয়েছে সুযোগ। স্যাটেলাইট প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের দেশের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা, দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
ইউরোপের এই উদ্যোগ ভবিষ্যতে আমাদের জন্য সহযোগিতা ও নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস