চীনের সামরিক শক্তি প্রদর্শন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি ও ভবিষ্যতের বার্তা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে চীন জুড়ে চলছে নানা আয়োজন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সামরিক কুচকাওয়াজ, যা চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক সক্ষমতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই আয়োজন শুধু সামরিক শক্তির প্রদর্শনী নয়, বরং বিশ্ব মঞ্চে নিজেদের অবস্থান জানান দেওয়ারও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের বিরুদ্ধে চীনের প্রতিরোধ যুদ্ধের স্মৃতি আজও তাদের জাতীয় পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
চীনের শেনইয়াং শহরে বসবাসকারী ৯২ বছর বয়সী প্রবীণ সেনা কর্মকর্তা ইয়াং হুয়াফেং, যিনি ১৯৪৯ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতা গ্রহণের সময়কার কুচকাওয়াজ প্রত্যক্ষ করেছিলেন, বর্তমান সামরিক শক্তি দেখে গর্বিত। তাঁর মতে, এখন চীনের আকাশপথে উড়োজাহাজ দেখলে কারও যেন চোখ তুলে তাকানোর সাহস হয় না।
এই অনুভূতিকে আরও দৃঢ় করতে কমিউনিস্ট পার্টি নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। নতুন যুদ্ধ বিষয়ক চলচ্চিত্র নির্মাণ, জাদুঘর সজ্জিত করা এবং কুচকাওয়াজের মতো আয়োজনের মাধ্যমে তারা জনগণকে এই সাফল্যের অংশীদার করতে চাইছে। এই কুচকাওয়াজে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনসহ বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
চীনের এই সামরিক শক্তি প্রদর্শনের মূল লক্ষ্য হলো– বহির্বিশ্বে নিজেদের শক্তিশালী ভাবমূর্তি তুলে ধরা। তারা প্রমাণ করতে চায় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গঠিত হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থার একটি বিকল্প তারা।
অভ্যন্তরীণভাবে, এই উদযাপন দেশের অগ্রগতির প্রতীক, যা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব এবং প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের প্রতি সমর্থন বাড়াতে সহায়তা করবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চীনের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা প্রায়শই ইউরোপের যুদ্ধ এবং প্রশান্ত মহাসাগরের নৌ-যুদ্ধগুলোর আলোচনায় চাপা পড়ে যায়। বর্তমানে, চীনের ক্ষমতাসীন দল এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে তাদের সাফল্যের গল্প হিসেবে তুলে ধরে, যা চীনা জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করতে সহায়তা করে।
চীনের এই উত্থান তাদের যুদ্ধ-সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন এনেছে। আগে, চীনের কমিউনিস্ট শাসনের প্রাথমিক বছরগুলোতে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের উপর বেশি জোর দেওয়া হতো। কিন্তু ১৯৭৮ সালে সংস্কার কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর, চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে জাতীয়তাবাদী চেতনা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, জাপানের বিরুদ্ধে জয়কে তারা একটি জাতীয় সাফল্যের প্রতীক হিসেবে গণ্য করতে শুরু করে। এর মাধ্যমে বোঝানো হয়, একসময় বিদেশি শক্তির দ্বারা দুর্বল চীন কিভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০১৪ সালে ৩ সেপ্টেম্বরকে ‘বিজয় দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। এর পরের বছর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে, তারা প্রথমবারের মতো সামরিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করে।
চীনের ইতিহাসবিদদের মতে, জাপানের বিরুদ্ধে জয় ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়, যা জাতির পুনর্গঠনের ভিত্তি স্থাপন করেছে।
চীনের প্রতিরোধ যুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনেক আগে, ১৯৩৭ সালে মার্কো পোলো ব্রিজ-এর কাছে জাপানি আগ্রাসনের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। বর্তমানে, চীনের পক্ষ থেকে এই যুদ্ধের সূচনা ১৯৩১ সাল থেকে হয়েছে বলে দাবি করা হয়, যখন জাপান মাঞ্চুরিয়া দখল করে।
এই অঞ্চলের জাদুঘরগুলোতে যুদ্ধের সময়কার বিভিন্ন নিদর্শন ও ছবি প্রদর্শন করা হচ্ছে, যা মানুষকে সেই সময়ের ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা দেয়। গাজার যুদ্ধ পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করে অনেকে এই যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেন।
চীনের এই সামরিক শক্তি প্রদর্শন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিচারণ, বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। রাশিয়া ও চীনের মধ্যে গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, যা বিশ্ব রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিত দেয়।
চীন নিজেকে বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতার রক্ষক হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে, বিশেষ করে যখন আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলোতে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানের মধ্যে বিদ্যমান সামরিক জোট, চীনকে মোকাবিলা করার জন্য আরও শক্তিশালী হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে, চীন রাশিয়া ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে প্রতিহত করতে চাইছে।
তারা বিশ্বকে জানাতে চায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস