সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অ্যামি কোনি ব্যারেট-এর নতুন বই: গর্ভপাতের অধিকার বিষয়ক রায় পুনর্বিবেচনার পক্ষে যুক্তি।
যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অ্যামি কোনি ব্যারেট সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর স্মৃতিকথায় গর্ভপাতের অধিকার বিষয়ক একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায়, ‘রো বনাম ওয়েড’-কে বাতিল করার স্বপক্ষে নিজের যুক্তি তুলে ধরেছেন। এই রায়ের মাধ্যমে দেশটির নারীদের গর্ভপাতের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ব্যারেট তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘রো বনাম ওয়েড’ রায়টি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের ইচ্ছার পরিপন্থী এবং এর ‘কিছু মূল্য’ দিতে হয়েছে।
৯ই সেপ্টেম্বর প্রকাশিতব্য ‘লিসেনিং টু দ্য ল’ (আইনের কথা শোনা) নামক এই বইয়ে ব্যারেট বলেছেন, আদালতের কাজ হলো জনগণের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানানো, তাদের কী বিষয়ে একমত হওয়া উচিত, তা নির্ধারণ করা নয়।
সিএনএন-এর হাতে আসা বইটিতে ব্যারেট তাঁর বিচারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি বিষয়ক অভিযোগ নিয়েও কথা বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, তাঁর চেম্বারে একবার শ্যাম্পেন দিয়ে উদযাপন করা হয়েছিল, যখন অন্য বিচারপতিরা তাঁর একটি ‘বিশেষ কঠিন’ রায়ের সঙ্গে একমত হয়েছিলেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগ পাওয়া তৃতীয় বিচারপতি ব্যারেট। নয় সদস্যের বেঞ্চে তিনি এখন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছেন। মামলার শুনানিতে যুক্তিতর্ক তৈরি করা থেকে শুরু করে রায় দেওয়ার ক্ষেত্রেও তাঁর মতামত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ২০২০ সালে উদারপন্থী বিচারপতি রুথ বেডার জিন্সবার্গের মৃত্যুর পর তাঁর শূন্যস্থান পূরণ করতে ব্যারেটের নিয়োগ হয় এবং এর মাধ্যমেই ‘রো বনাম ওয়েড’-এর অবসান হয়।
ব্যারেট (৫৩) জানিয়েছেন, আদালতের কার্যক্রম সম্পর্কে একটি সহজবোধ্য ধারণা দিতেই তিনি বইটি লিখেছেন। তবে তিনি শুরুতেই সতর্ক করে দিয়েছেন যে, নির্দিষ্ট মামলার অভ্যন্তরীণ আলোচনা বা তাঁর সাত সন্তানের নাম প্রকাশ করা হবে না। তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন রক্ষার স্বার্থে এমনটা করা হয়েছে।
যে মামলার রায় নিয়ে শ্যাম্পেন উদযাপন করা হয়েছিল, সেই মামলার কথাও তিনি সরাসরি উল্লেখ করেননি। সাধারণত বই প্রকাশের যে সময়সূচী থাকে, তাতে মনে করা হচ্ছে, সম্ভবত তিনি তাঁর সাম্প্রতিক একটি গুরুত্বপূর্ণ রায়ের কথা বলছেন, যেখানে তিনি নিম্ন আদালতের সেইসব বিচারকের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মত দিয়েছিলেন, যাঁরা জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বিষয়ক একটি নীতিকে বাধা দিয়েছিলেন।
প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, রক্ষণশীল প্রকাশনা সংস্থা ‘পেনগুইন র্যান্ডম হাউস’-এর ‘সেনটিনেল’ থেকে বইটি প্রকাশের জন্য ব্যারেট প্রায় ২ মিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২২ কোটি টাকার বেশি) অগ্রিম গ্রহণ করেছেন। সিএনএন-এর পক্ষ থেকে তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলেও তিনি রাজি হননি।
ব্যারেটের এই বইটি প্রকাশের পর অনেকেই আদালতের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হবেন। বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প কিভাবে আমেরিকার বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করতে পারেন, সে বিষয়ে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। ব্যারেটের নিয়োগের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টে রক্ষণশীলদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত হয়েছে।
ব্যারেট ট্রাম্পের বিষয়ে সরাসরি কিছু না বললেও লিখেছেন, আদালত সবসময়ই সময়ের সঙ্গে জড়িত।
তিনি আরও লিখেছেন, ‘আদালতের সামনে আসা চ্যালেঞ্জগুলির তীব্রতা হ্রাস-বৃদ্ধি হতে পারে, কিন্তু চ্যালেঞ্জগুলি কখনোই শেষ হবে না। প্রত্যেক বিচারপতির কাজ হলো আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে নিজের সেরাটা দেওয়া।’
২০২২ সালের ‘ডব্স বনাম জ্যাকসন উইমেন’স হেলথ অর্গানাইজেশন’ মামলায় গর্ভপাতের অধিকার বিষয়ক রায় পরিবর্তনের বিষয়ে ব্যারেটের গভীর উপলব্ধির কিছু অংশ বইটিতে তুলে ধরা হয়েছে।
বিচারপতি স্যামুয়েল আলিটোর সঙ্গে সুর মিলিয়ে ব্যারেট তাঁর বইয়ে স্পষ্ট করেছেন যে, গর্ভপাতকে কোনো সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না।
ব্যারেট উল্লেখ করেন, গর্ভপাতের অধিকার যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অন্যান্য সাংবিধানিক অধিকারের মতো গভীর শিকড় গেড়ে বসেনি। তাঁর মতে, ‘এই প্রমাণ পাওয়া যায় না যে, আমেরিকান জনগণ ঐতিহ্যগতভাবে গর্ভপাতের অধিকারকে স্বাধীনতার জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছে যে, এটি সংবিধানে ‘স্বতঃসিদ্ধ’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে। বরং, প্রমাণ এর বিপরীত দিকে ইঙ্গিত করে। গর্ভপাতের যেমন দীর্ঘদিনের কোনো আইনি সুরক্ষা ছিল না, তেমনই এটি দীর্ঘদিন ধরে নিষিদ্ধ ছিল।’
ব্যারেট তাঁর এই যুক্তির স্বপক্ষে বিচারপতি রুথ বেডার জিন্সবার্গের একটি মন্তব্যের উল্লেখ করেছেন। জিন্সবার্গ, যিনি নিজেও গর্ভপাতের অধিকারের সমর্থক ছিলেন, ‘রো’ মামলার প্রায় কুড়ি বছর পরে বলেছিলেন যে, এই রায় সম্ভবত ‘সংস্কারের দিকে এগিয়ে যাওয়া একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেছে’, ‘বিভেদকে দীর্ঘায়িত করেছে’ এবং ‘বিষয়টির স্থিতিশীল সমাধানে বিলম্ব ঘটিয়েছে’।
আদালতের অভ্যন্তরীন কার্যক্রম এবং বিচারপতিদের কাজ প্রায়ই সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য থেকে যায়। ব্যারেট নিজেও একজন প্রভাবশালী বিচারপতি, তবে তিনি বেশ রহস্যময়ও বটে। উদাহরণস্বরূপ, আগস্ট মাসের একটি মামলার কথা বলা যায়, যেখানে ট্রাম্প প্রশাসনকে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অফ হেলথ-এর প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলার গবেষণা অনুদান বন্ধ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
ব্যারেট স্বীকার করেছেন, একসময় তিনি বাইরের মানুষ ছিলেন এবং বিষয়গুলো নিয়ে হতাশ ছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘আদালতে যোগ দেওয়ার আগে আমি মাঝে মাঝে একটি রায়ের অস্পষ্ট ভাষা বা সুস্পষ্ট বিষয়গুলো পরিষ্কার করতে ব্যর্থ হওয়ায় হতাশ হতাম। এখন আমি বুঝি, বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া প্রায়ই ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়।’
তিনি আরও জানান, কোনো মামলার রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে যদি বিচারপতিরা মূল সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হন, কিন্তু কিছু আনুষঙ্গিক বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন, তবে রায়ের পরিসর কমিয়ে আনার যথেষ্ট কারণ থাকে।
তবে ব্যারেট মাঝে মাঝে বিরক্তও হন। তিনি বলেন, ‘কিছু বিষয় এড়িয়ে যাওয়া হয়তো একটি সাধারণ ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়ার মূল্য, যদিও আমি যে বিষয়গুলো যুক্ত করতে চাই, সেগুলো বাদ দেওয়াটা হতাশাজনক।’
সুপ্রিম কোর্টের একটি রায় দেওয়ার জন্য পাঁচজন বিচারপতির সমর্থন প্রয়োজন। ব্যারেট লিখেছেন, যখন তাঁকে আদালতের রায় লেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়, তখন তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে এবং অতিরিক্ত ভোট অর্জনের জন্য কাজ করেন।
ব্যারেটের খসড়া রায় অন্যান্য বিচারপতিদের কাছে পাঠানো হলে তাঁর সহযোগী আইনজীবীরা খেয়াল করেন, কারা এর সঙ্গে একমত হচ্ছেন।
তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে ভালো দিনগুলো হলো যখন দ্রুত এবং কোনো পরিবর্তন ছাড়াই ‘যোগদান’ বিষয়ক বার্তা আসে। একবার, যখন অন্যান্য বিচারপতিরা আমার একটি বিশেষ কঠিন রায়ের সঙ্গে দ্রুত একমত হয়েছিলেন, তখন আমার চেম্বারে তাৎক্ষণিকভাবে শ্যাম্পেন দিয়ে উদযাপন করা হয়েছিল। তবে বেশিরভাগ সময়েই কিছু পরিবর্তনের অনুরোধ আসে—কিছু সহজ, আবার কিছু ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কাজ করতে হয়। পরের অনুরোধগুলো শ্যাম্পেনের উপলক্ষ হয় না, কারণ রায় তৈরির পর এটি পুনর্লিখনের কাজটি বেশ কষ্টকর।’
আদালতের জরুরি কার্যক্রম নিয়েও তিনি কথা বলেছেন। জরুরি আবেদনের মাধ্যমে বিচারপতিরা দ্রুত প্রাথমিক আপিলগুলো নিষ্পত্তি করেন। সম্প্রতি ট্রাম্প প্রশাসন নিম্ন আদালতের বিভিন্ন রায়ের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়েছিল। রক্ষণশীল সংখ্যাগরিষ্ঠতা সম্পন্ন সুপ্রিম কোর্ট সেই ক্ষেত্রে প্রশাসনের পক্ষেই রায় দিয়েছে।
ব্যারেট তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘বিচারপ্রার্থীদের জরুরি আবেদন দাখিল করা অব্যাহত থাকলে, আদালতকে সেগুলোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
তবে তিনি এ কথাও স্বীকার করেছেন যে, পূর্ণাঙ্গ শুনানির সুযোগ থাকলে বিচারব্যবস্থা আরও ভালোভাবে কাজ করতে পারে।
২০১৭ সালে সিনেটর ডিয়ানে ফেইনস্টাইন ব্যারেটের মনোনয়ন শুনানিতে তাঁর ক্যাথলিক ধর্ম বিশ্বাসের বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়, তা হলো আপনার মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাস প্রবলভাবে বিদ্যমান। আর যখন আপনি এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর বিচার করেন, যা নিয়ে অনেক মানুষ দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম করেছেন, তখন এটি উদ্বেগের কারণ হয়।’
ব্যারেটের সমর্থনে অনেকে মনে করেছিলেন, ফেইনস্টাইন হয়তো একটি ‘ধর্মীয় পরীক্ষা’ চালাচ্ছেন।
বইতে ব্যারেট ফেইনস্টাইনের নাম উল্লেখ না করে লিখেছেন, ‘কেউ কেউ মনে করেন, ধার্মিক মানুষের পক্ষে আইনের পরিবর্তে তাঁদের নৈতিক মতামত অনুসরণ করা কঠিন। আমি ক্যাথলিক হিসেবে এই ধরনের সমালোচনার শিকার হয়েছি, বিশেষ করে সপ্তম সার্কিটের জন্য আমার মনোনয়ন শুনানির সময়।’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘সৌভাগ্যবশত, আমাদের দেশের জন্য, ধার্মিক ব্যক্তিরাই একমাত্র আমেরিকান নন, যাঁরা ভালো-মন্দের বিষয়ে দৃঢ় ধারণা পোষণ করেন। অধার্মিক বিচারকদেরও গভীর নৈতিক অঙ্গীকার থাকে, যার অর্থ হলো তাঁদেরও সেই অঙ্গীকার এবং আইনের চাহিদার মধ্যে বিরোধের সম্মুখীন হতে হয়।’
ব্যক্তিগতভাবে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও, ২০১৩ সালের বোস্টন ম্যারাথন বোমা হামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়া দ্জখার তের্নায়েভের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার বিষয়ে ব্যারেট তাঁর মত প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, ‘আমার জন্য, মৃত্যুদণ্ডের মামলাগুলো আইন এবং আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাসের মধ্যে সংঘাত তৈরি করে। … আইনের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার শপথ নেওয়ার অর্থ হলো, আইন কী, সে সম্পর্কে আমার সর্বোত্তম বিচারবুদ্ধি দিয়ে প্রতিটি মামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া। আমি যদি আইন কী হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে আমার বিচারবুদ্ধির ভিত্তিতে একটি মামলার সিদ্ধান্ত নিই, তবে আমি প্রতারণা করছি।’
তথ্য সূত্র: সিএনএন