আর্টিক সাগরের বরফ বাঁচানোর উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা: বাংলাদেশের জন্য কতটা উদ্বেগের?
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর দুই মেরু অঞ্চলের বরফ দ্রুত গলতে শুরু করেছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের এক গুরুতর ইঙ্গিত। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে।
এই পরিস্থিতিতে, বিজ্ঞানীরা উত্তর মেরুর বরফকে বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন অভিনব কৌশল নিয়ে কাজ করছেন। সমুদ্রের নিচে বিশাল “সাগরী পর্দা” তৈরি করা থেকে শুরু করে বরফকে পুনরায় জমাট বাঁধানোর মতো উচ্চ প্রযুক্তি-নির্ভর পরিকল্পনাগুলো এখন আলোচনার কেন্দ্রে।
কিন্তু সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই ধরনের পরিকল্পনাগুলির কার্যকারিতা এবং পরিবেশের উপর এর সম্ভাব্য ক্ষতির দিকগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
গবেষণা বলছে, এই পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নযোগ্য নয় এবং এর ফল হতে পারে মারাত্মক। বিজ্ঞানীরা উত্তর এবং দক্ষিণ মেরুর বরফ শীতল করার জন্য প্রস্তাবিত পাঁচটি পদ্ধতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন।
এই পদ্ধতিগুলির মধ্যে রয়েছে, বিশাল আকারের “সাগরী পর্দা” তৈরি করা, যা সমুদ্রের স্রোতকে প্রভাবিত করবে এবং বরফ গলন প্রক্রিয়াকে ধীর করবে; অথবা সমুদ্রের উপরিভাগে সূক্ষ্ম কাঁচের কণা ছড়িয়ে দেওয়া, যা সূর্যের তাপ শুষে নিতে বাধা দেবে এবং বরফ গলন রোধ করবে।
এছাড়াও, বরফের নিচে জমে থাকা জল অপসারণের জন্য ছিদ্র করার পরিকল্পনাও রয়েছে।
গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণাগুলো হয়তো ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে, তবে এগুলো ত্রুটিপূর্ণ। কারণ, মেরু অঞ্চলের পরিবেশ অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং এখানে আগে কখনো মানুষ এমন কোনো কাজ করেনি।
এইসব পদ্ধতির কোনোটিই এখনো পর্যন্ত বৃহৎ পরিসরে পরীক্ষা করা হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, “সাগরী পর্দা” তৈরি করলে সিল ও তিমি সহ সামুদ্রিক প্রাণীর আবাসস্থলে ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
আবার, কাঁচের কণা ছড়ানোর ফলে আর্কটিক অঞ্চলের খাদ্য শৃঙ্খলে ঝুঁকি দেখা দিতে পারে।
গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, এই প্রকল্পগুলোর আর্থিক দিকটিও বেশ উদ্বেগের। প্রতিটি প্রকল্পের জন্য অন্তত ১০০০ কোটি মার্কিন ডলার খরচ হতে পারে।
“সাগরী পর্দা” তৈরি করতে এক দশকের জন্য প্রায় ৮০০০ কোটি ডলার লাগতে পারে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের এই সংকটকালে এমন উচ্চ ব্যয়ের প্রকল্পগুলো বাস্তবসম্মত নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কোনো বিকল্প নেই। এই ধরনের প্রকল্পগুলো বরং মূল সমস্যা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দেয়।
তবে, কিছু বিজ্ঞানী মেরু অঞ্চলের এই ধরনের গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। তাদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মেরু অঞ্চলে যে ক্ষতি হচ্ছে, তা মোকাবিলায় এই গবেষণাগুলো জরুরি।
অন্যদিকে, কেউ কেউ মনে করেন, এই ধরনের প্রকল্পগুলো কেবল কার্বন নিঃসরণ কমানোর ক্ষেত্রে মনোযোগ সরিয়ে দেয়।
পরিবেশ বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেছেন, মেরু অঞ্চলের এই জটিল এবং সুক্ষ্ম বাস্তুতন্ত্রে সামান্যতম পরিবর্তনও দীর্ঘমেয়াদে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
এই গবেষণা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের মতো নিচু উপকূলীয় দেশগুলোর জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই, কার্বন নিঃসরণ কমানো এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, বরফ গলন প্রতিরোধের এইসব উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা হয়তো সমাধান নয়, বরং এটি একটি বিপদ সংকেত।
তথ্য সূত্র: সিএনএন