ওজন কমানো কেন এত কঠিন? বিশেষজ্ঞের বিস্ফোরক বিশ্লেষণ!

স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা: ওজন কমানো কেন কঠিন, এবং কিভাবে মোকাবেলা করবেন?

আজকাল, স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ছে, বিশেষ করে অতিরিক্ত ওজন এবং তার স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা বাড়ছে। ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের মতো সমস্যাগুলো যাদের ওজন বেশি, তাদের মধ্যে দ্রুত বাড়ছে।

ওজন কমানোর ধারণাটা সহজ—কম খান, বেশি নড়াচড়া করুন। কিন্তু বাস্তবে, অনেকের জন্য এটি একটি কঠিন লড়াই। ওজন কমানো শুরু করলেও, মাঝে মাঝে গতি কমে যায়, অথবা আবার আগের ওজনে ফিরে আসার প্রবণতা দেখা যায়।

কেন এমন হয়? আসুন, এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ওজন কমানো কঠিন হওয়ার মূল কারণগুলো আমাদের শরীরের জীববিজ্ঞান, জিনগত বৈশিষ্ট্য, পরিবেশ এবং এমনকি মস্তিষ্কের গঠনগত দিকের সঙ্গে জড়িত। শরীরের ওজন কমানোর প্রক্রিয়াটিকে প্রতিরোধ করার একটি প্রবণতা থাকে।

শরীরে যখন চর্বি কমে, তখন মস্তিষ্ক এটিকে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। ক্ষুধা বাড়ে এবং শরীরের মেটাবলিজম কমে যায়।

ডাঃ জেনাহ সিওয়াক, একজন ফ্যামিলি এবং ওবেসিটি মেডিসিনের চিকিৎসক (সোশ্যাল মিডিয়ায় @drjennahsiwak নামে পরিচিত), ওজন কমানোর এই সমস্যাগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে, ওজন কমানোর ক্ষেত্রে আমাদের শরীরের কিছু নিজস্ব কৌশল কাজ করে।

মস্তিষ্কের ভূমিকা:

আমাদের মস্তিষ্ক সবসময় শরীরের ওজনকে একটি নির্দিষ্ট সীমায় রাখতে চায়। এটিকে রক্ষা করার জন্য, যখন ওজন কমে, তখন শরীরে ক্ষুধার অনুভূতি বাড়ে। এর ফলে বেশি খাবার খাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়।

এই প্রক্রিয়াটি বিবর্তনের ফল, যা একসময় খাদ্যের অভাবের সময় আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করত। কিন্তু বর্তমানে যখন সহজে ক্যালোরিযুক্ত খাবার পাওয়া যায়, তখন এই প্রক্রিয়াটি ওজন কমানোর ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে।

জিনগত প্রভাব:

কিছু মানুষের ক্ষেত্রে, তারা যা খুশি তাই খেলেও ওজন বাড়ে না, আবার কারো ক্ষেত্রে খুব সামান্য খেলেও ওজন বেড়ে যায়। এর কারণ হলো জিনগত বৈশিষ্ট্য। গবেষণায় দেখা গেছে, শরীরের ওজন (BMI) এর প্রায় ৪০-৭০% পর্যন্ত জিন দ্বারা নির্ধারিত হয়।

তবে, জিনের সাথে পরিবেশ ও জীবনযাত্রারও একটা সম্পর্ক রয়েছে।

শরীরের মেটাবলিজম বা বিপাক ক্রিয়ার পরিবর্তন:

ওজন কমানোর সময় আরেকটি সমস্যা হলো শরীরের মেটাবলিজম কমে যাওয়া। যখন ওজন কমে, শরীর এটিকে একটি বিপদ হিসেবে দেখে। ফলে ক্ষুধা বাড়ে এবং ক্যালোরি পোড়ানোর গতি কমে যায়।

শরীরের এই পরিবর্তনগুলো ওজন কমানোর প্রক্রিয়াকে কঠিন করে তোলে।

মানসিক চাপ, ঘুম এবং আবেগ:

মানসিক চাপ এবং ঘুমের অভাব আমাদের শরীরের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে এবং মানসিক চাপে থাকলে, শরীরে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়, যা ওজন কমাতে বাধা দেয়।

মানসিক চাপের কারণে অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার প্রবণতা বাড়ে। তাই, ওজন কমাতে চাইলে পর্যাপ্ত ঘুম ও মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা করতে হবে।

পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা:

আমরা কোথায় বাস করি, কাজ করি, এবং আমাদের চারপাশে কি খাবার পাওয়া যায়, তার উপরও ওজন কমানো নির্ভর করে। যারা দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেন, বিশেষ করে রাতের শিফটে, তাদের শরীরের স্বাভাবিক ছন্দ (সার্কেডিয়ান রিদম) ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা ক্ষুধা ও মেটাবলিজমের উপর প্রভাব ফেলে।

এছাড়া, যেখানে স্বাস্থ্যকর খাবার পাওয়া কঠিন, সেখানে সহজে পাওয়া যায় এমন ক্যালোরিযুক্ত খাবারের উপর নির্ভর করতে হয়, যা ওজন কমাতে বাধা দেয়। কিছু ঔষধও ওজন বাড়াতে পারে।

তাই, ঔষধ সেবনের আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

ওজন কমানোর ক্ষেত্রে কিছু বিষয় মনে রাখতে হবে:

  • ওজন কমালে তা ধরে রাখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
  • একটি নির্দিষ্ট সময় পর ওজন কমা কমে যেতে পারে, একে প্লেটু বা ওজন কমার গতি কমে যাওয়া বলা হয়।
  • ধৈর্য্য ধরে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে এবং হতাশ হওয়া যাবে না।

ডাঃ সিওয়াক বলেন, ওজন কমানো কঠিন, কারণ আমাদের শরীর তার চর্বি ধরে রাখতে চায়। তাই, চেষ্টা করেও যদি ওজন কমাতে সমস্যা হয়, তবে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। বরং, শরীরের এই স্বাভাবিক প্রবণতাকে বুঝে, সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে।

স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা ও সঠিক খাদ্যাভ্যাস এর মাধ্যমে ওজন কমানো এবং তা বজায় রাখা সম্ভব।

ওজন কমানোর জন্য একটি ক্যালোরি ঘাটতি তৈরি করতে হবে। তবে, কিভাবে এই ঘাটতি তৈরি করবেন, তা আপনার জীবনধারা ও পছন্দের উপর নির্ভর করে। সবচেয়ে ভালো উপায় হলো এমন একটি ডায়েট বেছে নেওয়া, যা আপনি দীর্ঘ সময় ধরে চালিয়ে যেতে পারবেন।

ডাঃ জেনাহ সিওয়াক আরও বলেন, ওজন কমানোর ক্ষেত্রে নিজের শরীরকে বোঝা খুবই জরুরি। এই বিষয়ে ভালোভাবে জানার মাধ্যমে, আমরা আমাদের শরীরের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে পারি।

এই নিবন্ধটি তৈরি করা হয়েছে ডা. জেনাহ সিওয়াকের ধারণা থেকে, যিনি একজন ফ্যামিলি ও ওবেসিটি মেডিসিনের চিকিৎসক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *