শিরোনাম: হামাস নেতাদের কাতারে লক্ষ্য করে হামলা, নেতানিয়াহুর ‘রণকৌশল’ কি ভেস্তে গেল?
জেরুজালেম থেকে প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু হামাস নেতাদের বিরুদ্ধে কাতার-এ বিমান হামলার নির্দেশ দিয়ে এক বড় ধরনের জুয়া খেলেছেন। কিন্তু মনে হচ্ছে, সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে এবং এর ফল উল্টো হয়েছে।
গত মঙ্গলবার কাতারে চালানো বিমান হামলায় হামাসের শীর্ষস্থানীয় নেতারা নিহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া যায়নি। হামাস দাবি করেছে, তাদের নেতারা অক্ষত আছেন। অন্যদিকে, এই ঘটনার জেরে নেতানিয়াহুর আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ এবং মানবিক বিপর্যয়ের কারণে তাঁর ভাবমূর্তি এরই মধ্যে দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
এই হামলা কাতারকে ক্ষুব্ধ করেছে, যারা এই যুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। এছাড়াও, আরব বিশ্বজুড়ে এর তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সৃষ্টি হয়েছে সম্পর্কের টানাপোড়েন। এমনকি, যুদ্ধবিরতি আলোচনার সম্ভাবনাও ভেস্তে যেতে বসেছে, যা গাজায় জীবিত থাকা ২০ জন জিম্মির জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলেছে।
যদিও এই হামলা নেতানিয়াহুর জন্য একটি বড় ধাক্কা, তবুও তিনি পিছিয়ে আসার কোনো লক্ষণ দেখাচ্ছেন না। বরং গাজায় যুদ্ধ বন্ধের কোনো ইঙ্গিতও দেননি। তাঁর কট্টরপন্থী জোট এখনো তাঁর প্রতি অবিচল সমর্থন জানাচ্ছে, ফলে নেতানিয়াহুর ক্ষমতা হারানোর কোনো সম্ভাবনা আপাতত নেই।
হামলায় হামাসের কয়েকজন জুনিয়র সদস্য এবং একজন কাতারি নিরাপত্তা রক্ষী নিহত হয়েছেন। তবে হামাস দাবি করেছে, মার্কিন যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করার জন্য বৈঠকে বসা নেতারা সবাই বেঁচে গেছেন। যদিও হামাস তাদের নেতাদের কোনো ছবি প্রকাশ করেনি এবং কাতারও তাদের অবস্থা সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেনি।
তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের আরব বিষয়ক বিশেষজ্ঞ হারেল চোরেভ বলেছেন, যদি শীর্ষ নেতৃত্ব নিহত হতো, তবে নেতানিয়াহুর জন্য হামাসকে নির্মূল করার ঘোষণা দেওয়ার সুযোগ আসত। তিনি বলেন, “এটা খুবই প্রতীকী এবং এটি অবশ্যই এমন একটা বিষয় যা নেতানিয়াহুকে একটা নির্দিষ্ট সময়ে বলতে সাহায্য করত, ‘আমরা জিতেছি, আমরা তাদের সবাইকে মেরে ফেলেছি।
গাজায় ইসরায়েলের দীর্ঘ ২৩ মাসের হামলায় হামাসের শীর্ষস্থানীয় নেতারা নিহত হয়েছেন। তবে নেতানিয়াহু “পূর্ণ বিজয়” অর্জনের লক্ষ্যে দলটিকে নির্মূল করতে বদ্ধপরিকর।
বর্তমানে, এই লক্ষ্য অর্জন কঠিন হয়ে পড়ছে। এর ফলে নেতানিয়াহুর পক্ষে তাঁর কট্টরপন্থী জোটের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। ইসরায়েলের ক্ষমতাসীন জোটের চরমপন্থী সদস্যরা নেতানিয়াহুকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। তারা গাজা সিটিতে অভিযান আরও প্রসারিত করার জন্য চাপ দিচ্ছে। যদিও সামরিক নেতৃত্ব এবং ইসরায়েলের জনগণের মধ্যে এর বিরোধিতা রয়েছে।
চোরেভের মতে, ইসরায়েল শুরু থেকেই দোহায় হামাস নেতাদের ওপর আঘাত হানতে পারত, তবে আলোচনা চলার সময় কাতারকে বিরক্ত করতে চায়নি। কাতার এর আগে দুটি যুদ্ধবিরতি আলোচনায় মধ্যস্থতা করেছে, যার মাধ্যমে ১৪৮ জন জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল আটজনের মরদেহ। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জীবিত অবস্থায় মাত্র আটজন জিম্মিকে উদ্ধার করতে পেরেছে এবং ৫১ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করেছে।
চোরেভ আরও বলেন, “এই হামলার মাধ্যমে ইসরায়েল বিশ্বকে জানিয়েছে যে তারা আলোচনার পথ ত্যাগ করেছে। তারা কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
যুদ্ধবিরতি আলোচনা অব্যাহত থাকবে কিনা জানতে চাইলে কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুলরহমান আল থানি বলেন, এই হামলার পর “বর্তমান আলোচনায় আর কিছু অবশিষ্ট নেই” বলে তিনি মনে করেন। তবে তিনি বিস্তারিত কিছু বলেননি এবং মধ্যস্থতা বন্ধ করার কথাও সরাসরি জানাননি।
নেতানিয়াহু কীভাবে জিম্মিদের মুক্তি নিশ্চিত করবেন, তা এখনো স্পষ্ট নয়। বৃহস্পতিবার, শেখ মোহাম্মদ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জিম্মিদের প্রতি উদাসীনতার অভিযোগ করেন। তিনি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বলেন, “আজকের দিনে ইসরায়েলকে যারা শাসন করছেন, সেই চরমপন্থীরা জিম্মিদের নিয়ে চিন্তিত নন—নতুবা, এই হামলার সময়কে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করব?”
তবে তিনি আরও বলেন, তাঁর দেশ মধ্যস্থতা পুনরায় শুরু করতে প্রস্তুত আছে, তবে পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে কোনো ইঙ্গিত দেননি। শুক্রবার, শেখ মোহাম্মদ ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। মার্কো রুব এই সপ্তাহান্তে ইসরায়েল যাওয়ার কথা রয়েছে, যা উভয় মিত্র দেশের মধ্যে সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য ট্রাম্প প্রশাসনের চেষ্টারই অংশ।
অন্যদিকে, ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, তিনি বিমান হামলায় “অত্যন্ত অসন্তুষ্ট” এবং কাতারকে আশ্বাস দিয়েছেন যে এমন ঘটনা আর ঘটবে না। তবে ট্রাম্প ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবেন কিনা বা নেতানিয়াহুকে যুদ্ধ বন্ধ করতে চাপ দেবেন কিনা, সে বিষয়ে কিছু জানাননি।
নেতানিয়াহু অবশ্য নিরুৎসাহিত হননি এবং হামাস নেতৃত্ব কাতার-এ থাকলে আরও পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, হামাসের প্রতি বার্তা পরিষ্কার: “এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে আমরা তোমাদের কাছে পৌঁছতে পারব না।”
গাজায় চলমান যুদ্ধে এর প্রভাব এখনো স্পষ্ট নয়। ইসরায়েল গাজা সিটি জয়ের লক্ষ্যে তাদের অভিযান জোরদার করেছে। সামরিক বাহিনী শহরটি থেকে প্রায় ১০ লাখ মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষক গায়িল তালশির বলেছেন, “নেতানিয়াহুর সরকার গাজায় সামরিক অভিযান চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।”
তিনি আরও বলেন, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং পশ্চিমা দেশগুলো থেকে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানানো হলেও, ইসরায়েল তা উপেক্ষা করেছে।
ইসরায়েলের এই পথ পরিবর্তনের একমাত্র উপায় হতে পারেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি ইসরায়েলকে বলতে পারেন, “যথেষ্ট হয়েছে।”
ইসরায়েলের গণতন্ত্র ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট ইয়োহানান প্লেসনার বলেছেন, “নিকট ভবিষ্যতে নেতানিয়াহুর ভবিষ্যৎ ইসরায়েলি জনগণের ওপর নির্ভর করে না।”
বরং, তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তাঁর জোটের ওপর, যারা এই হত্যা প্রচেষ্টাকে সম্পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে।
এই ঘটনায় জিম্মিদের পরিবারের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে এবং তাঁদের কষ্ট আরও বেড়েছে। ম্যাটান নামে এক জিম্মির মা আইনভ জাঙ্গাউকার এই সপ্তাহে দোহায় ইসরায়েলের হামলার কথা শুনে “ভয়ে কাঁপছিলেন।” তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রশ্ন করেন, “প্রধানমন্ত্রী কেন একটি চুক্তির প্রতিটি সম্ভাবনা ধ্বংস করতে এত মরিয়া?”
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস