মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের মধ্যে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া সামরিক মহড়াগুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এই মহড়াগুলো এমন একটি সময়ে অনুষ্ঠিত হলো, যখন রাশিয়া, চীন ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে গভীর সামরিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ঘটনাগুলো বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার লড়াইকে আরও তীব্র করে তুলেছে।
সম্প্রতি, কোরিয়া উপদ্বীপের কাছে ‘ফ্রিডম এজ ২০২৫’ নামে একটি যৌথ নৌ ও বিমান মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। এই মহড়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র হুমকি মোকাবিলা করা এবং এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।
দক্ষিণ কোরিয়ার জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফ এক বিবৃতিতে জানায়, এই মহড়াটি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নত করতে সহায়তা করবে। একই সময়ে, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মধ্যে ‘রেসোলিউট ড্রাগন’ নামে আরেকটি সামরিক মহড়া অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপকারী যন্ত্র ব্যবহার করা হয়।
সামরিক মহড়াগুলোর কয়েকদিন আগেই, চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে রাশিয়া, চীন ও উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ নেতাদের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে দেশ তিনটি তাদের সামরিক শক্তি প্রদর্শন করে এবং অভূতপূর্ব ঐক্যের বার্তা দেয়।
বিশ্লেষকদের মতে, এই জোটবদ্ধতা পশ্চিমা বিশ্বের জন্য একটি সতর্কবার্তা। উত্তর কোরিয়া রাশিয়াকে অস্ত্র ও সৈন্য দিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধে সহায়তা করছে এবং এর বিনিময়ে তারা রাশিয়ার কাছ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি পেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, চীন দীর্ঘদিন ধরে কোরিয়া উপদ্বীপকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত করার কথা বললেও, বেইজিংয়ে কিম জং-উনের সঙ্গে বৈঠকের পর তারা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এর মাধ্যমে চীন কার্যত উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে।
সামরিক মহড়াগুলোর তীব্র সমালোচনা করেছে উত্তর কোরিয়া। দেশটির কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের ভাইস-চেয়ারম্যান পাক জং চন এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ফ্রিডম এজ’ হলো কোরিয়া উপদ্বীপে চালানো সবচেয়ে বড় ও আগ্রাসী সামরিক মহড়া।
চীনও যুক্তরাষ্ট্রকে জাপানে ‘টাইফুন’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা মোতায়েন না করার আহ্বান জানিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ইওয়া ওমেনস ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক লিফ-এরিক ইজলি বলেন, বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত সামরিক কুচকাওয়াজ ছিল একটি প্রতীকী ঘটনা, যেখানে দেশগুলো তাদের ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যমে বহিরাগত চাপ প্রতিরোধের বার্তা দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যেকার সামরিক মহড়াগুলো রাজনৈতিক মঞ্চের চেয়ে বেশি বাস্তব সহযোগিতা ও সমন্বয় এর উদাহরণ।
দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নিরাপত্তা সহযোগিতা অনেক আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল, যা পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের সঙ্গে প্রসারিত হয়েছে।
কোরিয়া ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল ইউনিফিকেশনের একজন ঊর্ধ্বতন গবেষক, হং মিন মনে করেন, উত্তর কোরিয়াকে প্রতিরোধের জন্য এই দেশগুলোর মধ্যে দৃঢ় সম্পর্ক প্রয়োজন।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো শুধু কোরিয়া উপদ্বীপেই নয়, বরং দক্ষিণ চীন সাগরেও সামরিক মহড়া চালিয়েছে। গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ফিলিপাইনের মধ্যে দ্বিতীয় দফা মহড়া অনুষ্ঠিত হয়, যা বিতর্কিত জলসীমায় চীনের ক্রমবর্ধমান আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা আরও জোরদার করার ইঙ্গিত দেয়।
এছাড়া, তাইওয়ান প্রণালীতেও যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটিশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ টহল দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই সামরিক তৎপরতাগুলো বিশ্বে তাদের মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও সুসংহত করছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক কমান্ডের জয়েন্ট ইন্টেলিজেন্স সেন্টারের সাবেক পরিচালক কার্ল শুস্টার বলেন, এই ধরনের মহড়াগুলো এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আমেরিকার মিত্রদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সহযোগিতা ও পারস্পরিক সক্ষমতার প্রমাণ।
মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ডের মতে, এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং সাধারণ হুমকি মোকাবিলায় দেশগুলোর মধ্যে সামরিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তথ্য সূত্র: সিএনএন