যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি: ২০২৬ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে ট্রাম্পের পরীক্ষা, যা ওবামা পারেননি।
যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন মধ্যবর্তী নির্বাচন, যা ২০২৬ সালে অনুষ্ঠিত হবে, রিপাবলিকান পার্টির (জিওপি) জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হতে চলেছে। এই নির্বাচনে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি যে ভোটারদের আকৃষ্ট করেছিলেন, তাদের ধরে রাখাটা এখন রিপাবলিকানদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
বিশ্লেষকদের মতে, এই কাজটি করতে পারলে তবেই দলটি তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে পারবে, যা বারাক ওবামার আমলে ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্য কঠিন ছিল।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের প্রধান সাফল্য ছিল তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত কিছু ভোটারকে নির্বাচনে আগ্রহী করে তোলা। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ ছিলেন কম বয়সী শ্বেতাঙ্গ নন-গ্র্যাজুয়েট পুরুষ এবং হিস্পানিক সম্প্রদায়ের মানুষ।
এখন রিপাবলিকানদের চ্যালেঞ্জ হলো, মধ্যবর্তী নির্বাচনে এই ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে ফিরিয়ে আনা। কারণ, সাধারণত মধ্যবর্তী নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তুলনায় কম থাকে।
ন্যাশনাল রিপাবলিকান কংগ্রেসনাল ক্যাম্পেইন কমিটির প্রেস সচিব মাইক মারিনেলার মতে, “এই নির্বাচনের মূল প্রশ্ন হলো, গত নির্বাচনে যারা এত বিপুল সংখ্যায় ভোট দিয়েছেন, তাদের কিভাবে আবার ভোট কেন্দ্রে আনা যায়।”
ট্রাম্পের এই চ্যালেঞ্জ অনেকটা বারাক ওবামার সময়কার ডেমোক্রেটদের সমস্যার মতোই। ওবামাও ২০০৮ সালের নির্বাচনে নতুন ভোটারদের সমর্থনে জয়লাভ করেছিলেন।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে মধ্যবর্তী নির্বাচনগুলোতে তিনি সেই ভোটারদের ধরে রাখতে ব্যর্থ হন, যার ফলস্বরূপ ২০১০ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে ডেমোক্রেটদের বড় পরাজয় ঘটে।
যদিও রিপাবলিকানদের ক্ষেত্রে ঝুঁকির পরিমাণ ততটা বেশি নয়, কারণ ডেমোক্রেটদের মতো তাদের এতগুলো আসন রক্ষার চ্যালেঞ্জ নেই। তবে, প্রতিনিধি পরিষদ এবং সিনেটে রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা খুবই সামান্য। ফলে, সামান্য কিছু আসনে হারলেও তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাতে পারে।
মারিনেলার মতে, রিপাবলিকানরা আত্মবিশ্বাসী যে ট্রাম্পের সমর্থকরা আগামী নির্বাচনেও তাদের পাশে থাকবেন। তবে জনমত জরিপগুলোতে দেখা যাচ্ছে, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা কমেছে। বিশেষ করে হিস্পানিক, তরুণ এবং কলেজ-শিক্ষিত নন এমন শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে।
ডেমোক্রেটদের ধারণা, রিপাবলিকানরা মধ্যবর্তী নির্বাচনে ট্রাম্পের সমর্থকদের ধরে রাখতে পারবে না। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, “এই গুরুত্বপূর্ণ ভোটার গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সমর্থন কমে যাচ্ছে, যা রিপাবলিকানদের জন্য একটি খারাপ নির্বাচনের ইঙ্গিত দেয়।”
এমনটাই বলছেন ডেমোক্রেটিক পোলিং সংস্থা নেভিগেটর রিসার্চের সিনিয়র ডিরেক্টর এরিকা সেইফার্ট।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে মধ্যবর্তী নির্বাচনগুলো সাধারণত ক্ষমতাসীন দলের জন্য কঠিন হয়ে থাকে। ওবামার সময়ে ডেমোক্রেটদের জন্য এটি আরও কঠিন ছিল। এর কারণগুলো ট্রাম্পের ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক হতে পারে।
ওবামা তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভালো ফল করলেও, মধ্যবর্তী নির্বাচনে ডেমোক্রেটদের দল ভালো করতে পারেনি। ২০১০ সালের নির্বাচনে ডেমোক্রেটরা প্রতিনিধি পরিষদের ৬৪টি আসন হারায় এবং ২০১৪ সালে সিনেটে ৯টি আসন হারায়।
ডেমোক্রেটিক ডেটা ও অ্যানালিটিক্স সংস্থা ক্যাটালিস্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে যারা ভোট দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে প্রায় ৪৮ মিলিয়ন মানুষ ২০১০ সালের নির্বাচনে ভোট দেননি। আবার, ২০১২ সালের নির্বাচনে ভোট দেওয়া প্রায় ৫২ মিলিয়ন মানুষ ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভোট দেননি।
অর্থাৎ, প্রতিবারই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তুলনায় মধ্যবর্তী নির্বাচনে প্রায় ৪০ শতাংশ ভোটার ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন।
এই বিশাল পরিবর্তনের কারণে ওবামার সময়কার মধ্যবর্তী নির্বাচনগুলোতে ডেমোক্রেটদের জন্য কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। কারণ, ডেমোক্রেটরা সাধারণত তরুণ এবং সংখ্যালঘু ভোটারদের সমর্থন পেত। কিন্তু মধ্যবর্তী নির্বাচনগুলোতে সেই সমর্থন কমে যায়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ডেমোক্রেটরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বছরগুলোতে ভালো করলেও, মধ্যবর্তী নির্বাচনগুলোতে তাদের দুর্বলতা দেখা যায়। ট্রাম্পের সময়ে অবশ্য পরিস্থিতি কিছুটা বদলে যায়।
২০১৮ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে ডেমোক্রেটরা প্রতিনিধি পরিষদে ৪০টি আসন জয়লাভ করে। ২০২২ সালের নির্বাচনে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়, কিন্তু তাদের আসন সংখ্যা অপ্রত্যাশিতভাবে বেশি ছিল।
মধ্যবর্তী নির্বাচনের এই নতুন চিত্র পরিবর্তনের কারণ হলো, শ্বেতাঙ্গ এবং কলেজ-শিক্ষিত ভোটারদের সমর্থন কমে যাওয়া। ওবামার সময়ে রিপাবলিকানরা এই শ্রেণির ভোটারদের বেশি সমর্থন পেত। কিন্তু ট্রাম্পের কারণে অনেক ভোটার তাদের থেকে দূরে চলে যায়।
ট্রাম্পের প্রথম মধ্যবর্তী নির্বাচনে ডেমোক্রেটরা নতুন ভোটারদের সমর্থন লাভ করে। ক্যাটালিস্টের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালের নির্বাচনে যারা ভোট দেননি, তাদের মধ্যে ১৪ মিলিয়নের বেশি মানুষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোট দেন। এই নতুন ভোটারদের বেশিরভাগই ডেমোক্রেটদের সমর্থন করেছিল।
২০২০ সালের নির্বাচনেও এই নতুন ভোটাররা ব্যাপক সংখ্যায় ভোট দেয় এবং বাইডেনকে সমর্থন করে। কিন্তু ট্রাম্পও কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে তরুণ, হিস্পানিক ও এশীয়-মার্কিন ভোটারদের মধ্যে ভালো ফল করেন।
২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে বাইডেনের প্রতি অসন্তুষ্টির কারণে অনেক ভোটার ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন। ফলে, রিপাবলিকানরা প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ফিরে পায়।
২০২৪ সালের নির্বাচনেও একই চিত্র দেখা যায়। বাইডেনের সমর্থকরা ভোট দিতে যাননি, অন্যদিকে ট্রাম্প নতুন ভোটারদের সমর্থন লাভ করেন। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, ট্রাম্প সাধারণত কম পরিচিত এবং অনিয়মিত ভোটারদের সমর্থন পেয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্যাট্রিক রুফিনির মতে, ট্রাম্প এমন একজন প্রার্থী যিনি সাধারণত নির্বাচনে আগ্রহী নন, এমন ভোটারদেরও আকৃষ্ট করতে পারেন।
২০২৬ সালের নির্বাচনে রিপাবলিকানদের জন্য চ্যালেঞ্জ হলো, ট্রাম্পের নতুন ভোটারদের ধরে রাখা। মারিনেলার মতে, হিস্পানিক ভোটার এবং রুস্ট বেল্টের শ্রমিক শ্রেণির ভোটাররা রিপাবলিকানদের দিকে ঝুঁকছে এবং এই প্রবণতা মধ্যবর্তী নির্বাচনগুলোতেও বজায় থাকবে।
তবে, ডেমোক্রেটদের মতে, ট্রাম্পের নতুন ভোটাররা এখন দ্বিধাগ্রস্ত। নেভিগেটর পোলিংয়ের জরিপে দেখা গেছে, ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা কমেছে। বিশেষ করে যারা নিয়মিত খবর দেখেন না, এমন ভোটারদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা কমেছে।
ডেমোক্রেট পোলস্টার কার্লোস ওডিওর মতে, ট্রাম্পের অনেক হিস্পানিক সমর্থক তাদের ভোট নিয়ে অনুশোচনা করছেন। জনমত জরিপে দেখা গেছে, হিস্পানিক এবং তরুণ ভোটারদের মধ্যে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা কমেছে।
রাজনৈতিক কৌশলবিদ মাইকেল পডহোরজারের মতে, ট্রাম্পের জন্য ২০২৬ সালের নির্বাচনে দুটি ঝুঁকি রয়েছে। প্রথমত, জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়ের কারণে তার নতুন ভোটাররা হতাশ হতে পারে। দ্বিতীয়ত, ট্রাম্পের আগ্রাসী নীতি পুরনো সমালোচকদের আবার সক্রিয় করতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক এরিকা সেইফার্টের মতে, ট্রাম্পের প্রতি অসন্তুষ্ট হলেও, ডেমোক্রেটদের প্রতি ভোটারদের আস্থা এখনো বাড়েনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মধ্যবর্তী ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মধ্যে ভোটারদের অংশগ্রহণে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়, যা পুরো নির্বাচনী চক্রকে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছে। ২০২৬ সালের নির্বাচনে রিপাবলিকানদের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো এই পরিবর্তনশীলতা।
তবে, ডেমোক্রেটদের সতর্ক থাকতে হবে। কারণ, তারা যদি ২০২৬ সালের নির্বাচনে ভালো ফল করে, তবে এর অর্থ এই নয় যে, ২০২৮ সালের নির্বাচনেও তারা ভালো করবে। কারণ, সেই নির্বাচনে অনিয়মিত ভোটাররা আবার ভোট দিতে আসতে পারে।
কামালা হ্যারিসের নির্বাচনী প্রচারণার পরিচালক ড্যান ক্যানিনেনের মতে, ডেমোক্রেটদের সতর্ক থাকতে হবে এবং ২০২৬ সালের ফলাফল থেকে ভুল শিক্ষা নেওয়া উচিত নয়।
তথ্য সূত্র: সিএনএন